আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের এক বছর
‘তারা চায়, আমার চাকরি যেন ভাইকে দিয়ে দিই’

ছবি: বিবিসি
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২ | ০০:০১ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২ | ০০:১৯
যখন কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামবেন প্রথম যে বিষয়টি আপনি দেখবেন তা হলো, ব্রাউন স্কার্ফ ও কালো বোরকা পরা নারী পাসপোর্টে স্ট্যাম্পিংয়ের কাজ করছেন। এটি এমন এক বিমানবন্দর যেখানে ঠিক এক বছর আগে হাজার হাজার মানুষ বেপরোয়াভাবে দেশ ছেড়ে পালানোর অপেক্ষায় ছিলেন। তবে বর্তমানে এটি অনেকটা শান্ত ও পরিচ্ছন্ন। গ্রীষ্মের বাতাসে পতপত করে উড়ছে তালেবানের পতাকা।
এটি দেশের প্রবেশদ্বারের দৃশ্য। তালেবানের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার প্রথম বছরে এ প্রবেশদ্বারের বাইরের অবস্থা কী তার খণ্ড চিত্র এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
কাবুল, যেখানে নারীর চাকরি দিতে বলা হচ্ছে পুরুষকে
বার্তাগুলো অতিমাত্রায় চমকপ্রদ।
একটি যোগাযোগমাধ্যমে এক নারী লিখেছেন, ‘তারা চায়, আমি আমার চাকরি যেন আমার ভাইকে দিয়ে দিই।’
অপর এক নারী লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান অর্জন করেছি অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার মাধ্যমে… যদি আমরা এ দাবি মেনে নিই, এর অর্থ হবে নিজেদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।’
প্রতিবেদক অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা তাকে জানিয়েছেন চাকরির বিষয়ে পাওয়া বার্তা সম্পর্কে।
তারা এমন একটি দলের অংশ যেখানে রয়েছে ৬০ এরও বেশি নারী। যাদের অধিকাংশই রাজস্ব অধিদপ্তরের। যারা একত্রিত হয়েছেন গত আগস্টের পর থেকে যখন তাদের বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
তারা বলেন, তালেবান কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন, আমাদের পুরুষ আত্মীয়ের সিভি পাঠাতে যার এ চাকরির উপযুক্ত।
নিরাপত্তার শঙ্কা থেকে পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করে এক নারী জোর দিয়ে বলেন, ‘এটি আমার চাকরি। আমি ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা জটিলতা পার করে এ চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি এবং মাস্টার্স করেছি। এখন আমরা আবার নেমে এসেছি শূন্য পর্যায়ে।’
রাজস্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক আমিনা আহমাদি, যিনি দেশ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি টেলিফোনে বিলাপ করতে করতে বলেন, আমরা আমাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলছি।
সাবেক এ কর্মকর্তারা এখন তাদের চাকরি ফেরত চান। এ নারীরা গত দুই দশক ধরে শিক্ষা ও চাকরির সুবিধা পেয়ে এসেছেন দেশটিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে। তালেবানের উত্থানে যার ইতি ঘটেছে।
যদিও তালেবানের কর্মকর্তারা বলছেন, নারীরা এখনো কাজ করছেন। যারা মূলত স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক এবং নিরাপত্তাকর্মী।
তালেবান আরও বলছে, নারীরা সরকারি চাকরির এক চতুর্থাংশ ছিলেন। যাদের এখনো বেতনের সামান্য অংশ দেওয়া হচ্ছে।
ঘোর প্রদেশে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা
পরিবেশ শান্ত। আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলের উঁচু অংশ ঘোর প্রদেশে গমের সোনালী শস্য গ্রীষ্মের রোদে ঝলমল করছে। শোনা যাচ্ছে, গরুর মৃদু ডাক।
১৮ বছর বয়সি নুর মুহাম্মদ ও ২৫ বছর বয়সি আহমদ কাজ করছেন শস্যের মাঠ পরিষ্কারের জন্য।
নুর বলেন, ‘খরার কারণে খুবই কম গম উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু এটিই একমাত্র চাকরি, যা আমি পেয়েছি।’
পাশেই রয়েছে ফসলের মাঠ। যেখানে ফসল কেটে রাখা হয়েছে। সেখানে দশ দিন ধরে কাজ করছেন দুই জন। তাদের মজুরি দৈনিক ২ ডলার।
নুর বলেন, আমি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম কিন্তু পরিবারকে সহযোগিতা করতে গিয়ে আমার পড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদের গল্পও করুণ। তিনি বলেন, আমি আমার মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়েছিলাম ইরান যাওয়ার জন্য কিন্তু আমি কোনো চাকরি খুঁজে পাইনি।
ইরানে মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আফগানিস্তানের অনেকেই। বিশেষ করে কম সমৃদ্ধ প্রদেশগুলোর মানুষ এসব কাজ করতে যান। কিন্তু ইরানেও চাকরি বাজারের অবস্থা ভালো নয়।
নুর বলেন, আমরা তালেবান ভাইদের স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু আমাদের এমন সরকার দরকার যারা আমাদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে।
কথা হয়েছে ঘোর প্রদেশের গভর্নর আহমদ শাহ দিন দোস্তের সঙ্গে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য, বাজে সড়ক, হাসপাতালের রুগ্ন রূপ ও বিদ্যালয় ঠিকভাবে না চলা— এসব সমস্যার কারণে আমি হতাশ।

যুদ্ধের ইতি ঘটার অর্থ হলো— অনেক সাহায্য সংস্থা এখানে কাজ করছে। চলতি বছরের শুরুতে প্রদেশের দুই জেলায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানা যায়।
কিন্তু আহমদ শাহর যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাকে জেলে রেখেছিল এবং নির্যাতন করেছিল।
তিনি বলেন, আমাদের আর কষ্ট দেবেন না। পশ্চিমের কাছ থেকে আমাদের সহযোগিতার দরকার নেই। কেন পশ্চিম সবসময় হস্তক্ষেপ করে? আমরা তো জিজ্ঞাস করছি না তারা কীভাবে নারী ও পুরুষদের সঙ্গে আচরণ করে।
একইদিন একটি বিদ্যালয় ও ক্লিনিক ঘুরে দেখেছেন বিবিসির প্রতিনিধি।
তালেবানের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক আব্দুল সাত্তার মাফাক বলেন, আফগানিস্তানের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। আমাদের মানুষের জীবন বাঁচানো প্রয়োজন।
তখনই নুর মুহাম্মদের বলা একটি কথা বিবিসির প্রতিনিধি স্মরণ করছেন। সেটি হলো— দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ এক ধরনের লড়াই। এ লড়াই অস্ত্রের লড়াইয়ের চেয়ে গুরুতর।
হেরাতে ক্লাসের বাইরে মেধাবী ছাত্রী
১৮ বছর বয়স সোহাইলার। সে উত্তেজনায় ছটফট করছে। হেরাতে নারীদের একটি মার্কেটে তার সঙ্গে কথা হয় বিবিসির। এ প্রদেশটি বিজ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগামিতার জন্য বিখ্যাত ছিল।
এ মার্কেট সেদিন প্রথমবারের মতো খুলল গত বছর তালেবান বন্ধ করে দেওয়ার পর। সোহাইলার পরিবারের দোকানের সামনে কথা হয়। যদিও এটিও এখনো প্রস্তুত হয়নি।
সে বলল, দশ বছর আগে আমার বোন এ দোকানটি শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর।

সে জানাল, তার বোন ইন্টারনেট হাব ও রেস্তোরাঁও খুলেছেন। এ মার্কেটেই একটু নারীরা তাদের কাজ কারবার ঠিকমতো করতে পারছেন।
সোহাইলার রয়েছে ভিন্ন একটি গল্প। সে জানাল, তালেবান উচ্চ বিদ্যালয় (নারীদের জন্য) বন্ধ করে দিয়েছে। আমি গ্রেড-১২ এর ছাত্রী ছিলাম। যদি আমি আমার পড়ালেখা শেষ করতে না পারি তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার হবে না।
তখন সে দেশেই থাকতে চায় কিনা জানতে চাইলে জবাবে সোহাইলা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, অবশ্যই। এটি আমার দেশ এবং আমি অন্য কোনো দেশে যেতে চাই না।
তবে এক বছর বিদ্যালয় বন্ধ থাকা সবার জন্যই দুঃখজনক। সে বলল, শুধু আমার জন্য নয়, এটি আফগানিস্তানের সব মেয়ের জন্যই মেনে নেওয়া কঠিন। এটি একটি বাজে অভিজ্ঞতা।

কান্নায় ভেঙে পড়ার আগে সোহাইলা বলল, ক্লাসে আমি সেরা ছাত্রী ছিলাম।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন প্রদেশ নিজেদের দখলে নিতে শুরু করে তালেবান। সব গোয়েন্দা অনুমান ছাড়িয়ে ১৫ আগস্ট এ গোষ্ঠীর দখলে চলে যায় রাজধানী কাবুল। এর পর থেকে নানা সংকটে নিমজ্জিত দেশটি। দেশটিতে পুনরায় তালেবান শাসনের এক বছরে সংকট কমার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছেই না উল্টো মনে হচ্ছে গভীর সংকটে তলিয়ে যাচ্ছে কাবুল।
- বিষয় :
- আফগানিস্তান
- তালেবান
- ক্ষমতা
- নারী শিক্ষা
- দুর্ভিক্ষ