হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ
গাজায় সর্বাত্মক অবরোধের হুমকি

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি-সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:১৩ | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:১৩
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যুদ্ধে ইসরায়েলে প্রাণহানি অব্যাহতভাবে বাড়ছেই। উভয় পক্ষের চলমান লড়াইয়ে প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালান্ট সোমবার বলেন, ‘আমি গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। বিদ্যুৎ, খাবার, গ্যাসসহ সবকিছুই সেখানে বন্ধ থাকবে।’ অপরদিকে হামাস শতাধিক ইসরায়েলি নাগরিককে বন্দি করেছে– স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন। হামলা বন্ধ না করলে যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে হামাস। তবে যে কোনো সময় যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনায় বসতে তারা প্রস্তুত।
ইসরায়েলে এখনও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র যোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান করছে বলে সর্বশেষ জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘আমি গাজার মানুষের উদ্দেশে বলছি, তোমরা সরে যাও। আমরা আমাদের সব শক্তি দিয়ে এখন সবখানে আক্রমণ চালাব।’ ইসরায়েলের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে রণতরী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সোমবার লড়াই তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। এতে এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক ইসরায়েলি নিহত এবং ২ হাজার ২৪৩ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সেনাসদস্য রয়েছে অন্তত ৭৩ জন। দক্ষিণ ইসরায়েলের কিবুতজে ১০০ ইসরায়েলির লাশ পেয়েছে উদ্ধারকর্মীরা। নিহতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৯, নেপালের ১০ ও থাইল্যান্ডের ১২ জন নাগরিক রয়েছে। ফিলিস্তিনে মারা গেছে ৬৮৭ জন। তাদের মধ্যে শতাধিক শিশু রয়েছে। আহত হয়েছে ৩ হাজার ৭২৬ জন।
ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গাজা উপত্যকার দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার এবং এটি ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত। সীমান্তের বড় অংশ রয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে, বাকিটা মিসরের সঙ্গে। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস এখানে। হামাস ক্ষমতায় আসার পর ২০০৭ সাল থেকেই গাজার ওপর অবরোধ বজায় রেখেছে ইসরায়েল।
সোয়া লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত
শনিবার ভোরের দিকে আকস্মিকভাবে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে হামাস। পরে গাজা উপত্যকায় স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে পাল্টা হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলছে, চলমান সহিংসতায় গাজায় ১ লাখ ২৩ হাজারের বেশি বাসিন্দা এরই মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রোববার স্থানীয় সময় রাত ৯টা পর্যন্ত প্রায় ৭৪ হাজার গাজাবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। গাজার হাসপাতালগুলো আহত মানুষে ভরে গেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার বাসিন্দাদের প্রায় ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভশীল। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রতিদিনকার খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।
বৃষ্টির মতো বোমা ছুড়ছে ইসরায়েল
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অব্যাহতভাবে বৃষ্টির মতো বোমা ছুড়ছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। এ ছাড়া সঙ্গে ড্রোন ব্যবহার করেও সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে।
গাজার আকাশ এখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন দিয়ে পূর্ণ। ইসরায়েলের বিমানবাহিনী জানিয়েছে, রোববার সারারাত ধরে গাজায় হামাস এবং ইসলামপন্থি জিহাদি দলগুলোর অন্তত ৫০০টি অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় ফাইটার জেট, হেলিকপ্টার, এয়ারক্রাফট এবং কামান ব্যবহার করা হয়েছে।
গাজার বাসিন্দা রেফাত আল-আরির আলজাজিরাকে বলেন, অবরুদ্ধ ছিটমহলে ইসরায়েলি বোমা হামলা এক মিনিটের জন্যও থামেনি। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের জন্য নিরাপদ কোনো স্থান নেই। গাজার দুটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে। একটি মসজিদেও হামলা হয়েছে।
রণতরী পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলের সহায়তায় বিমানবাহী রণতরীসহ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। হামাসের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে ইসরায়েলকে বাড়তি যুদ্ধ সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এ তথ্য জানিয়েছেন। ইতালির ভূমধ্যসাগর উপকূলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক জ্বালানিসমৃদ্ধ বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজের এই বহরে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী চারটি ডেস্ট্রয়ার ও একটি ক্রুজারও রয়েছে।
ইসরায়েলকে সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে হামাস। রাশিয়া বলেছে, পেন্টাগন থেকে যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী রণতরী ইসরায়েলের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ঘোষণার পর চলমান যুদ্ধে তৃতীয় পক্ষের প্রবেশের ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে।
ইসরায়েলের সংগীত উৎসবে নিহত ২৬০
ইসরায়েলে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের হামলায় এক সংগীত উৎসবে অন্তত ২৬০ জন নিহত হয়েছে। শনিবার ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় নেগেভ মরুভূমিতে সুপারনোভা সংগীত উৎসবেও হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। রাতব্যাপী উৎসবে প্রায় ৩ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল।
এ রকেট হামলা চলার সময় গাজার বহু যোদ্ধা সীমান্ত বেড়া ভেঙে, বেড়ার ওপর দিয়ে প্যারাগ্লাইডিং করে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে। নেগেভ মরুভূমির এ সংগীত উৎসবস্থলটি ছিল ইসরায়েলের কিবুতজ রিম গ্রামের কাছে, যা গাজা ভূখণ্ড থেকে তেমন দূরে নয়। অনুষ্ঠান চলার সময় পিকআপে ৫০ জন হামলাকারী সেখানে হাজির হয়। তাদের পরনে ছিল সামরিক উর্দি। উৎসবস্থল থেকে বেশ কয়েকজনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা।
ইসরায়েলি ভূখণ্ডে এখনও হামাসের লড়াই
সোমবারও ইসরায়েলের ভেতরে লড়াই চালিয়েছে হামাস। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকার কাছে অবস্থিত ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের সাত-আটটি স্থানে ইসরায়েলি বাহিনী এখনও হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করছে বলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী সোমবার সকালে এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে।
ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, হামাস যোদ্ধারা এখনও যেসব এলাকায় তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে বেইরি নামক একটি এলাকা রয়েছে। ইসরায়েলের কৃষিপ্রধান এই এলাকায় হামাস যোদ্ধারা গত শনিবার ভোরেই প্রবেশ করেছিল।
হামাস নেতা আব্দেল-লতিফ-আল-কানোয়া বার্তা সংস্থা এপির সঙ্গে এক টেলি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাদের এ অভিযানের লক্ষ্য হলো আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলিদের আগ্রাসন বন্ধ এবং ইসরায়েলি কারাগার থেকে সব ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্ত করা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ বলছে, গাজা থেকে রকেট ছুড়তে থাকায় এখন জেরুজালেম ও ইসরায়েলজুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বাজছে। জেরুজালেমে অন্তত তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এগুলো রকেট আছড়ে পড়ার পর বিস্ফোরণের শব্দ, নাকি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রকেটকে বাধা দিয়েছে– তা স্পষ্ট নয়।
ইসরায়েলের সংরক্ষিত বাহিনীর ৩ লাখ সদস্য তলব
শনিবার থেকে ৩ লাখ সংরক্ষিত সামরিক সদস্যকে তলব করেছে আইডিএফ। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশে অবস্থানরত ইসরায়েলি সংরক্ষিত বাহিনীর সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বেশির ভাগ ইসরায়েলি নাগরিকের জন্য কিছু সামরিক সেবা দেওয়া বাধ্যতামূলক, এমনকি তারা দ্বৈত নাগরিকত্বের হলেও। সাধারণত যুদ্ধের মতো বড় ঘটনায় এই রিজার্ভ ফোর্স বা সংরক্ষিত বাহিনীর সদস্যদের তলব করা হয়। আইডিএফ বলেছে, তারা শনিবার থেকে ৩ লাখ সংরক্ষিত সামরিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ওআইসি বৈঠকের আহ্বান ইরানের
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, গাজা সংকট নিয়ে দেশটি আঞ্চলিক উন্নয়ন বিষয়ে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে আলোচনার জন্য বুধবার বৈঠক ডেকেছে আরব লিগ।
ইরান জড়িত নয়– ব্লিংকেন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইরানের সমর্থনে হামাস আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে ইসরায়েলে হামাসের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের জড়িত থাকার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পায়নি। রোববার এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্লিংকেন এসব কথা বলেন।
এটি ইসরায়েলের ‘৯/১১’
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দু’জন সিনিয়র সদস্য হামাসের হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত ৯/১১-এর হামলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর নির দিনার বলেন, ‘এটি আমাদের ৯/১১।’ তিনি বলেন, তারা আমাদের পেয়ে বসেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জনাথান কনরিকাসও হামাসের এ হামলাকে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে ৯/১১ ও পার্ল হারবার যেন একসঙ্গে ঘটছে। এটি ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে দিন। এর আগে কখনও এক দিনে এত ইসরায়েলি কোনো ঘটনায় মারা যায়নি।’
ফিলিস্তিনিদের সাহায্য স্থগিত
হামাসের কঠোর সমালোচনা করে ফিলিস্তিনে প্রায় ৭৩ কোটি ডলারের সাহায্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অস্ট্রিয়া ও জার্মানি বলেছে, তারা ফিলিস্তিনিদের সাহায্য স্থগিত করেছে। তবে আয়ারল্যান্ড গাজাবাসীর সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
সূত্র : বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরা