মিয়ানমার পরিস্থিতি
রাখাইন, কাচিন ও কারেনে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ

.
তুহিন তৌহিদ
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:০১ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:০২
নির্মাণাধীন গির্জার দ্বিতীয় তলা থেকে এক তরুণ যোদ্ধা বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। দক্ষিণ মিয়ানমারের ছোট্ট গ্রামে দুই বছর ধরে এর নির্মাণকাজ চলছে। জায়ার নামে ২১ বছরের ওই যোদ্ধা জানান, নির্মাণকাজ চলছে খুব ধীরগতিতে।
জায়ার মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন থেকে আসা অনেক মুসলিম তরুণের একজন, যারা থাই সীমান্ত এলাকায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। কারেন প্রদেশের কাইন নামক ওই স্থানে জান্তা বাহিনীর বিমান হামলা সব সময় তাদের বড় হুমকি। তা সত্ত্বেও একটু একটু করে কারেন নৃগোষ্ঠীর লোকজন তাদের গির্জা গড়ে তুলছেন। জায়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়েছেন গত বছর। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, এখানে আসার আগে তিনি জানতেন যে কারেনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এখন দেখছেন আসল চিত্র।
আরও পড়ুন: গোলায় ঘুমধুমে দুই প্রাণহানি
বিশেষ লেখা- কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করতে হবে
জায়ারের বক্তব্যে মিয়ানমারে ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ধামাচাপা দেওয়ার যে চেষ্টা জান্তা বাহিনী যুগ যুগ ধরে করে আসছে, তা ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে সেখানে থাকা সংখ্যালঘুদের অবস্থাও জানা যাচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বছর পূর্ণ করেছে সামরিক সরকার। কিন্তু তাদের তৃতীয় বর্ষপূর্তিকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।
গত অক্টোবর থেকে এ জোট সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এরই মধ্যে তাদের ঐক্যবদ্ধ হামলায় ভেঙে পড়ছে জান্তা বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যুহ। বিভিন্ন প্রদেশে সামরিক বাহিনীর হাতছাড়া হচ্ছে একের পর এক ঘাঁটি। ইরাবতী অনলাইন জানায়, তিন দিনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ গেছে অন্তত ৬২ সেনার। রাখাইন, কাচিন ও কারেন প্রদেশে বিদ্রোহীরা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা সাফল্য পাচ্ছেন সাগাইন, মাগওয়ে ও মান্দালয় এলাকাতেও।
এ পরিস্থিতিতে জান্তাপ্রধান মিন অং হল্যাং নজিরবিহীন চাপে আছেন; তাঁর পদত্যাগের দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পিডিএফএস) ও নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো অপ্রতিরোধ্য গতিতে নতুন নতুন এলাকা দখল করে নিচ্ছে। তাদের আক্রমণে ঘাঁটি ও চৌকি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহীদের জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা বাহিনী ও মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের ব্যাপক লড়াই চলছে। বিদ্রোহীদের তীব্র হামলার মুখে পালাতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
১০ দিন আগে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় হোমালিন এলাকার সেউই পাই আই শহরটির দখল নিয়েছিল বিদ্রোহীরা। শনিবার এটি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করে সামরিক বাহিনী। পরে তারা সে অভিযান থেকে সরে আসে।
এ রকম বহু শহর এখন বিদ্রোহীদের দখলে, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে পারছে না সামরিক বাহিনী। দুই পক্ষের লড়াইয়ে সরকারি বাহিনী ড্রোন ও বিমান হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্রোহীরাও গুলি চালানোর পাশাপাশি ক্লাস্টার বোমা ও ল্যান্ড মাইন ব্যবহার করছে। ড্রোনও ব্যবহার করছে তারা। ছোট বিদ্রোহী সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের প্রতিরোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে জান্তা বাহিনী। কার্যত পুরো মিয়ানমার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে জান্তাপ্রধান হল্যাং দাবি করেছেন, বিদ্রোহীরা তাঁর বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী এবং আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে।
গত তিন দিনে বিদ্রোহীরা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। উত্তর মিয়ানমারের মান্দালয়ের শহরতলি মিনগাইনে ২০ সেনার একটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে পিডিএফ জোট। এতে অন্তত ১৫ সেনাসদস্য নিহত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। রোববার কাচিন রাজ্যে একটি ঘাঁটি দখলে নিয়ে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি। এ সময় জান্তা বাহিনীর অন্তত আট সদস্য নিহত হয়। কারেন রাজ্যে আরও অন্তত ২০ সেনা নিহত হয়েছে। সেখানে থানডাউনগিতে পিডিএফ ও কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সঙ্গে জান্তা সেনাদের লড়াই হয়।
যে সশস্ত্র সংগঠনগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করত, তারা এখন এককাতারে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। কার্যত এটাই বিপাকে ফেলেছে জান্তা সরকারকে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিম জলিফ বলেন, ঐক্য হলো বিদ্রোহীদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। এভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা কেবল সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্যই এনে দেবে না, পরবর্তী মিয়ানমার গঠনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
মিয়ানমারে অসন্তোষের একটি বড় কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য। বিদ্রোহী সংগঠন কেটিএলএর যোদ্ধা জায়ার বলেন, লড়াইয়ে অংশ নিতে তিনি সবকিছু ছেড়েছেন। কারণ, একনায়কের শাসনে বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। তিনি যুদ্ধ করছেন সমতার জন্য।
চলমান পরিস্থিতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমর্থকরাও জান্তাপ্রধান মিন অং হল্যাংয়ের পদত্যাগ দাবি করছে। রয়টার্স জানায়, অনেক বুদ্ধভিক্ষুও সরাসরি পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন। সেনাশাসনের সমর্থক ইউটিউবার ও ব্লগার কো মং মং বলেন, জান্তাপ্রধানের উচিত পদত্যাগ করা।
- বিষয় :
- মিয়ানমার
- সামরিক জান্তা