জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের পুনর্জন্ম

ছবি-সংগৃহীত
সাইফান সানাফ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ১০:৩৯
১৯৯৩ সাল। সারা দুনিয়ার সিনেমাপ্রেমীরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল পর্দায়– লম্বা ঘাড়ওয়ালা ব্র্যাকিওসরাস যখন মাথা তোলে আকাশের দিকে, তখন মনে হয়েছিল যেন আদি পৃথিবীর এক টুকরো ইতিহাস ফিরে এসেছে। সেটিই ছিল ‘জুরাসিক পার্ক’।
স্টিভেন স্পিলবার্গের হাত ধরে ‘জুরাসিক পার্ক’ প্রথমবারের মতো পর্দায় যখন এলো তখন থেকেই এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমাগুলো যেন পরিণত হয়েছে এক নিজস্ব ঘরানায়। কিছু বৈশিষ্ট্য যেন অমোঘভাবে জুড়ে গেছে প্রতিটি কিস্তিতে: একদল বিজ্ঞানী, কিছু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী চরিত্র, গোপনে বসে থাকা কোনো বিলিয়ন ডলারের করপোরেট ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি ডাইনোসর। তবে যতবারই পর্দায় তারা এসেছে, ততবারই কিছু সময়ের জন্য হলেও দর্শকদের মনে জেগে উঠেছে এক নিঃশব্দ বিস্ময়, এক অপার মুগ্ধতা।
গত তিন দশকেরও বেশি সময় ডাইনোসরদের নিয়ে এসেছে আরও ছয়টি সিনেমা। সব সিনেমাই একদম একরকম নয়। কিছু সিনেমা ভয়ের চেয়ে বিস্ময়ের ওপর বেশি জোর দিয়েছে, কিছু আবার নিখাদ থ্রিলের দিকে ঝুঁকেছে। ২০২২ সালের ‘ডমিনিয়ন’ সিনেমায় যেমন একটি দৃশ্যে দেখা যায় বরফে ঢাকা পরিবেশে দুটি ব্র্যাকিওসরাস ধীরে হেঁটে যাচ্ছে, আর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে। এই দৃশ্যটি ছিল বিরল, কারণ এতে ভয় নয়; বরং ডাইনোসরের প্রতি শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসাই ছিল মুখ্য।
এসব বলার কারণ একটাই– ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড রিবার্থ’ সেই বিস্ময় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। এই সিনেমার গল্পে দেখা যাবে, ডাইনোসরের উপস্থিতি এত সাধারণ হয়ে গেছে যে মানুষ বিরক্ত। রাস্তা বন্ধ করে দেয় তারা, কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়। ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড রিবার্থ’ নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, স্টুডিও ফ্র্যাঞ্চাইজিটিকে নতুনভাবে শুরু করতে চাইছে। ‘ডমিনিয়ন’-এর পরে গল্প শুরু হয়েছে, আগের মানব চরিত্রদের কেউ নেই।
এবারের গল্পে দেখা যাবে, মানুষ এখন ডাইনোসর ও তাদের থিম পার্ক নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন পৃথিবী ডাইনোসরদের থাকার জন্য অনুপযুক্ত। ফলে বেশির ভাগ ডাইনোসরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্জন এক দ্বীপে। ডাইনোসরদের সেই দ্বীপে রয়েছে অনেক মিউট্যান্ট। গল্পে দেখা যায় রুপার্ট ফ্রেন্ড অভিনীত ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসায়ী মার্টিন ক্রেবসকে। যে মানুষের জীবনের জন্য বিপ্লব ঘটাতে পারে এমন এক ওষুধ আবিষ্কারের জন্য ডাইনোসরের ডিএনএ চায়। তবে তা হতে হবে অনেক বড়, ভয়ংকর, জীবিত ডাইনোসরের; যা এখন সেই দ্বীপের মধ্যে রয়েছে। এই কাজের জন্য সে ভাড়া করে জোরা বেনেটকে (স্কারলেট জোহানসন)। বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিকে রাজি হয় সে। জোরা সাহায্যের জন্য ডাকে পুরোনো বন্ধু ও বোট-মালিক ডানকান কিনকেইড (মাহারশালা আলি)। সেই বোটে করেই তারা পৌঁছে যায় সেই দ্বীপে, যেখানে তিনটি বিরল ডাইনো প্রজাতি শান্তিতে বসবাস করছে। তাদের সঙ্গে আরও যোগ দেন ডাইনোসরপ্রেমী প্যালিওন্টোলজিস্ট ড. হেনরি লুমিস (জোনাথন বেইলি)। এই অভিযানের গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় একটি পরিবার। তারা সমুদ্রে ঘুরছিল, হঠাৎ এক বিশাল সামুদ্রিক ডাইনোসরের আক্রমণে নৌকা উল্টে যায়।
এবারের সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন গ্যারেথ এডওয়ার্ডস, যিনি ২০১৪ সালের ‘গডজিলা’ এবং ‘রগ ওয়ান: অ্যা স্টার ওয়ার্স স্টোরি’র জন্য খ্যাত। তাঁর ভাষায়, ‘এই সিনেমা শুধু ভয় আর ধ্বংসের নয়–এখানে সৌন্দর্যও আছে, অনেক গভীরতায়।’
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন এক দৃশ্য– যেখানে ব্র্যাকিওসরাসের একটি পরিবার সূর্যের আলোয় ভেজা ঘাসের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের লেজ যেন বাতাসে দুলে ওঠা এক রাজকীয় রিবন। এমন দৃশ্যগুলো যেন আবার মনে করিয়ে দেয়, ডাইনোসরেরা কেবল ভয় নয়, তারা প্রকৃতির এক অনন্য অলৌকিকতা। এ ছাড়াও আছে কিছু বিপদের মুখে ফেলার দৃশ্য, যেটি কিছু দর্শকের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তবে এটিই তো জুরাসিক পার্কের ট্র্যাডিশন।
পরিশেষে বলা যায়, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড রিবার্থ’ শুধু আরেকটি অ্যাকশনপ্যাকড সিনেমা নয়। এটি এক রূপক গল্প; যেখানে মানুষের লোভ, বিজ্ঞানের সীমাহীন হস্তক্ষেপ এবং প্রকৃতির অবহেলিত শ্রদ্ধার একটি দুঃস্বপ্ন জাগানিয়া প্রতিচ্ছবি। এটি মনে করিয়ে দেয় মানুষ সবসময় কেন্দ্র নয়, প্রকৃতি তার চেয়েও বড়। আর ডাইনোসররা শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়, তারা এক বিস্ময়, এক শিক্ষা। v