ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

অবহেলায় হারানো নারী তারকা ফুটবলারদের কথা কে মনে রাখে? 

অবহেলায় হারানো নারী তারকা ফুটবলারদের কথা কে মনে রাখে? 

আঁখি খাতুন, অনুচিং মগিনি ও রাজিয়া খাতুন

সুমন মেহেদী

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৪ | ১৭:২১ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ | ১৬:২৫

বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা ছোট-খাটো একটা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। পাহাড়ি আদিবাসী, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কিছু নিম্নবৃত্ত পরিবারের মেয়েদের পায়ে এই বিপ্লব ঘটেছে। তারা বয়সভিত্তিক একাধিক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পাশাপাশি সাফের মূল পর্বের শিরোপাও জিতেছে। দারিদ্র্য, সামাজিক বাধা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের বাধা পেরিয়ে এসে শীর্ষ পর্যায়ে মন জয় করা ফুটবল খেলছে এই মেয়েরা। কিন্তু প্রান্ত থেকে উঠে আসা এই মেয়েদের অনেকে অল্প দিনেই হারিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। 

রাজিয়ার মৃত্যু থেকে ওঠা প্রশ্ন
সম্প্রতি বয়সভিত্তিক সাফ জয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া খাতুন সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেছেন। তিনি সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এক ফুটবলার। ছিলেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে। এক পর্যায়ে ফুটবল ছেড়ে গ্রামে চলে যান। যদিও ফেরার প্রবল ইচ্ছে ছিল তার। ফেরা হয়নি। তার মতো, গত বছর হুট করে অবসর নেন জাতীয় দলের হয়ে সাফ জয়ী ২২ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্না। সাফে ৪ গোল করেছিলেন তিনি। একই বছর ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে ২০ বছরেই ফুটবল যাত্রার সমাপ্তি টানেন সাফজয়ী আনুচিং মগিনী।

চীনে ফুটবল খেলতে যাওয়া ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন নেই দেশের ফুটবলের কোথাও। তাদের মতো, রুপা আক্তার, মিসরাত জাহান মৌসুমী, সাজিদা খাতুনও হারিয়ে গেছেন। তাদের হারিয়ে যাওয়ার কারণ ইনজুরি। বাফুফে থেকে যথাযথ চিকিৎসা ও সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে ফুটবল ছাড়তে বাধ্য হন তারা। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এসব মেয়েরা ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার, নিজেরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ও সামাজিক মর্যাদা পাওয়া স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু দেশের নারী ফুটবলের কাঠামো বৈশ্বিক মানের ধারেকাছেও না থাকায় হারিয়ে যেতে হয় তাদের। 

ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের মেয়েরা এখনো খেলছে, কিন্তু কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সাবেক ছিটমহল বাঁশজানির ‘চ্যাম্পিয়ন’ মেয়েরা হারিয়ে গেছে। ২০১৮ সালে তারা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তার থেকেও এগিয়ে গিয়েছিল হ্যাটট্রিক কন্যাখ্যাত স্বরলিকা পারভীন। স্বরলিকা ও তার দল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও নিয়েছিল। তারপর মহামারি এল। অভাবে আর অনিশ্চয়তায় একে একে বাল্যবিবাহের শিকার হলো স্বরলিকাসহ সাতজন খেলোয়াড়। এই সাত কিশোরী এখন সংসারের জোয়াল বইছে। নওগাঁও ঘোড়সওয়ার মেয়ে তাসমিনার খবর কি আমরা রাখি?

২০১৭ সালের টুর্নামেন্ট সেরা স্বরলীকা পারভিন। ২০২১ সালে বাল্যবিয়েতে হারিয়ে যায় ফুটবল থেকে। ছবি: সংগৃহিত
কলসুন্দরের আরেক সাবিনা তিন দিনের জ্বরেই মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়। আমরা শুরু করি, কিন্তু শেষ করি না। কানে বাজে স্বরলিকার কথাটা, ‘আমরা গ্রামে বড় হচ্ছি। খেলাধুলার সুযোগ কমে আসছে। বিকেএসপি বা অন্য কোনো ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলে আমরা আরও ভালো করব।’

নারী ফুটবলাররা যেভাবে উঠে আসেন
বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারা উঠে আসে। পরে তাদেরথেকে বাছাই করে বাফুফের বয়সভিত্তিক ক্যাম্পে ডাকা হয়। অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত সাফ টুর্নামেন্টের জন্য বাফুফে তাদের প্রস্তুত করে। বাফুফে ভবনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাদের। পড়াশুনার পাশাপাশি সামান্য কিছু ভাতাও দেওয়া হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ আসরের পর জাতীয় দলে  ঢোকার লড়াই শুরু হয়। জাতীয় দলে জায়গা পাকা না হলে দেওয়া হয় না বেতন-ভাতা।  

নারী ফুটবলারদের বেতন-ভাতা
জাতীয় দলের ৩১ জনের মতো ফুটবলার বাফুফের থেকে বেতন পান। সেটাও নামমাত্র অর্থ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী- ১৫ জন ফুটবলার ৫০ হাজার টাকা, ১০ জন ৩০ হাজার এবং বাকিদের ১৮-২০ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। বাকি ফুটবলারদের লিগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

মেয়েদের ফুটবল লিগ কেমন
ছেলেদের ফুটবলের মতো বা বৈশ্বিক ফুটবলের মতো নয় বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল লিগ। বৈশ্বিক লিগ চলে প্রায় সারা বছর। ছেলেদের লিগেও ওই কাঠামো অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল লিগ সারা বছর তো নয়ই; চলে মাত্র দেড় মাস। সেখান থেকে তেমন রোজগার নারী ফুটবলাররা করতে পারেন না। আবার দেড় মাসের ফুটবলের জন্য সারা বছর ট্রেনিং করা, জিম করা, ফিটনেস নিয়ে কাজ করার মতো সুযোগ-সুবিধাও তারা পান না। 

নারী ফুটবলাররা খেলাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন না 
 বৈশ্বিক ফুটবল ক্লাব ভিত্তিক। ক্লাবের সঙ্গে ফুটবলাররা চুক্তিবদ্ধ হন। ক্লাব থেকেই বেতন-ভাতা পান। সারা বছর লিগ চলে। ফাঁকে ফাঁকে বসে আন্তর্জাতিক ফুটবলের মঞ্চ। সেজন্য ফেডারেশন থেকে ম্যাচ ফি পান তারা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে মেয়েদের লিগ ফুটবল এখনও সেভাবে দাঁড়ায়নি। ২০১১ সালে মেয়েদের লিগ ফুটবল শুরু হয়। পরের বছর আসরটি আর হয়নি। ২০১৩ সালে মাঠে গড়ায় দ্বিতীয় আসর। সাত বছর পর ২০১৯ সালে আবার মেয়েদের লিগ ফুটবল মাঠে ফেরে। যা পরের দুই বছর মাঠে গড়ালেও ২৩ সালে বন্ধ ছিল। ওই বছরই ফুটবল ছাড়েন বেশ কিছু ফুটবলার। এ বছরও ক্লাবগুলোর অনাগ্রহে মেয়েদের লিগ অনিশ্চিত। 

আর্থিক নিশ্চয়তাই কি ফুটবল ছাড়ার মূল কারণ
সম্প্রতি সমকালকে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা বলেছেন, ‘ক্যারিয়ারে সফলতা আসায় জিনিসগুলো ইতিবাচক হয়েছে।’ এই সফলতা পেছনে আর্থিক নিশ্চয়তা আছে। ছেলেদের তুলনায় কম হলেও ভালো বেতন পান নারী ক্রিকেটাররা। কিন্তু ফুটবলে ফেডারেশন থেকে মেয়েরা একেবারেই কম বেতন পান। জাতীয় দলভুক্ত না হতে পারলে ওই বেতনটুকুও পাওয়া যায় না। দেড় মাসের লিগ ফুটবলকে পেশাও বলা চলে না। যে কারণে ফুটবল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গতি থাকে না অনেকের।  

মেয়েদের ফুটবলে ধরে রাখতে করণীয়
বেশি সংখ্যক নারী ফুটবলারদের কেন্দ্রীয় চুক্তিভুক্ত করতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হতে পারে। যদিও বাফুফে বরাবর বলে আসছে- তাদের আর্থিক কাঠামো ভালো নয়। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যেহেতু ফুটবল লিগ ভিত্তিক সেজন্য বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল লিগকে সারা বছরের লিগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং বৈশ্বিক কাঠামোয় নিতে সরকারের পাশাপাশি ফুটবল ক্লাব ও সংগঠকরা এগিয়ে আসতে পারে।

সাফ কাপের চ্যাম্পিয়নরা সবাই গ্রামের গরিব পরিবারের মেয়ে। শহুরে মধ্যবিত্তদের চেয়ে কি তারা কম সাহসী, কম প্রগতিশীল? গ্রামীণ রক্ষণশীলতার মিথ ভেঙে দিয়েছে এসব মেয়ে, তাদের পরিবার ও তাদের শিক্ষকেরা। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যা যা করার  দরকার  ছিল, তা কি করা হয়েছে? রাজিয়া খাতুন ও সাবিনার মৃত্যু কিংবা স্বরলিকাদের হতাশা যেন আমরা মনে রাখি।  

আরও পড়ুন

×