ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

জীবন বাজি রেখে তুলেছিলেন জেনোসাইডের ছবি

২৫ মার্চ কালরাত

জীবন বাজি রেখে তুলেছিলেন জেনোসাইডের ছবি

নূরুল উলা

হিলাল ফয়েজী

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪ | ২২:২২

লেখাটি শুরু করেছি ২৩ মার্চ শনিবার রাত পৌনে ১০টায়। ৫৩ বছর আগে ২৩ মার্চ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’; সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে এক সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি।

বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে। সেই পতাকা পল্টন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এনে সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী। সেই ছবি আজ বড় আকারে পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত। নূরে আলম সিদ্দিকী প্রয়াত। 

তখন টগবগ করে ফুটছিল রাজনীতির সমুদ্রজল। বঙ্গবন্ধু জানতেন, আঘাত আসছে। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ সকালে ন্যাপ নেতা পাঠান ওয়ালী খান এবং বেলুচ সিংহ বেজেঞ্জো বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ৩২-এ গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনারা এখানে কেন? যত দ্রুত সম্ভব চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। ইয়াহিয়া খান সমঝোতায় আসেননি। বড় হামলা হবে। 

তারপর? ২৫ মার্চ, ১৯৭১। ইতিহাসের অন্যতম বর্বর জেনোসাইড শুরু হলো ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, পিলখানা ইপিআর সদরদপ্তর, নয়াবাজারসহ ঢাকার সর্বত্র ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, রাইফেল আর বিস্ফোরক দিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিল। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিলেন। সেই থেকে ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। তারপর তো দেশজুড়ে হানাদার হার্মাদদের ক্রম-জেনোসাইড কতভাবে, কত নিষ্ঠুরতায়, কত বর্বরতায়! 

জেনোসাইডের প্রমাণ? ২৫ মার্চ, ১৯৭১। সারারাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ হলে গুলি, রক্তধারা, আগুন। সকাল হতেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে একজন মহান দুঃসাহসী শিক্ষক, যার নাম নূরুল উলা, অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সেকালের মুভি ক্যামেরায় টেলিস্কোপ লাগিয়ে জগন্নাথ হলের বর্বর হত্যাকাণ্ডের চলমান ছবি তুললেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

নূরুল উলা স্যার, আজ বেঁচে নেই। দেশ স্বাধীন হলে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, নীরবে নিঃশব্দে কত বড় দায়ভার তিনি পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ভেজা অনুরোধে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে বঙ্গবন্ধু খবর পাঠালেন আমাদের দুঃসাহসী বীর শিক্ষক নূরুল উলাকে। নূরুল উলা গেলেন ৩২ নম্বরে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে পরামর্শরত বঙ্গবন্ধু। নূরুল উলাকে একধারে নিয়ে সকাতর শিশুর আবেগে বলে উঠলেন, আমাকে একটি ট্রান্সমিটার বানিয়ে দে। আমি যাবার আগে শেষবার দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে যাব। স্বাধীনতার কথা বলে যাব। 
নূরুল উলা ফিরলেন তাঁর শিক্ষালয়ে। বিভাগীয় শিক্ষকদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জহুরুল হকসহ সবাই ওই ট্রান্সমিটার তৈরিতে নিয়োজিত হয়ে গেলেন। অবশ্য ট্রান্সমিটারটি আর ৩২-এ নেওয়া যায়নি। 

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন দীর্ঘকাল ধরে চেনে না, জানে না এই মহান বীর শিক্ষক নূরুল উলাকে; ড. জহুরুল হকের মতো নিবেদিত প্রবীণ শিক্ষককে। 

এবার ২৬ মার্চ অবশেষে ড. নূরুল উলাকে স্মরণ করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা অন্য মুখে শুনেছি। অথচ ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলাম সাধারণ সম্পাদক ইউকসুতে। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশী হয়েছিলেন, তাদের কোনো তালিকা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, স্থপতি আলমগীর কবির, স্থপতি মোবাশ্বের বাবুল, কর্নেল প্রকৌশলী নূরুন্নবী, প্রকৌশলী ফওজুল আকবর, প্রকৌশলী আবুল কাসেম, স্থপতি মুজাহিদ চৌধুরী, প্রকৌশলী ইউসুফ সালাহউদ্দিন, ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা  প্রকৌশলী সিদ্দিকুর রহমান মানু, প্রকৌশলী মেজর (অব.) কাজী কামাল, প্রকৌশলী অরুণ কান্তি চক্রবর্তী প্রমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননাবিহীন কতজনের কথা। মনে পড়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মিজানুল হক (সাবেক এমপি) ক্লাসরুম থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটি নৃশংস আলবদরদের শিকার সতীর্থ তিন শহীদ বদিউল-বুলবুল-দুলালের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেছে কখনও?

এমনই মর্মান্তিক পটভূমিতে অধ্যাপক ড. নূরুল উলা, হে মহান বীর শিক্ষক, ওপার থেকে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন কি? আপনার অনবদ্য বীরত্ব এবং সাহসের স্বীকৃতি আমরা দিতে পারিনি। তবুও বলছি, জানি না কোন সাহসে, এই স্বীকৃতি অবশ্যই সমুজ্জ্বল ফুটে উঠবেই একদিন। আপনার তোলা টুকরো চলচ্চিত্র দিয়েই ১৯৭১-এর জেনোসাইডকে বিশ্বস্বীকৃতি এনে দেওয়ার শপথ নিচ্ছি পুনর্বার।

পরিশেষে দাবি তুলছি কার কাছে, জানি না স্যার! আপনার সেই ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর কোয়ার্টারে একটি জাদুঘর গড়ে তুলে সাহসের সেই ঝড়কে চিরায়ত করে তুলি! যথাযথ কর্তৃপক্ষ যারাই হোন না কেন, উদ্যোগ নেবেন কি?

হিলাল ফয়েজী: প্রধান সমন্বয়ক, আমরা একাত্তর

আরও পড়ুন

×