ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

স্লোভাকিয়া

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারই কি রবার্ট ফিকোর কাল হলো?

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারই কি রবার্ট ফিকোর কাল হলো?

.

ইফতেখারুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ০০:৫৩

বুধবার স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর (৫৯) ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে এ নিয়ে বেশ তর্ক চলছে। বিশ্বনেতার অনেকেই ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন। গত বছর নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন তুলে নেন এবং শিগগির দেশটিতে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়; রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তীব্র সমালোচনা করেছেন ফিকো। এলজিবিটিকিউর পক্ষে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমাদের চালানো প্রচারণার বিপক্ষেও তিনি ছিলেন তৎপর। সম্প্রতি অভিবাসনবিরোধী ও সমলিঙ্গের বিয়েকে তিনি ‘বিকৃত’ বলেও মন্তব্য করেছেন। কয়েক বছর ধরে তিনি পাশ্চাত্য জোটবিরোধী তৎপরতা বেশ জোরেশোরে প্রচার করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্য হওয়া ঠেকাবেন বলেও মন্তব্য করেন। 

স্পষ্টত ফিকোর প্রায় সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা পাশ্চাত্যবিরোধী। চিন্তা ও মননে তিনি বামপন্থি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মস্কোপন্থি ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এমন অবস্থান তাঁকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত কয়েক বছর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে দেশটিতে তাঁর বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ আছে নিশ্চয়। কিন্তু আদতে এ পরিস্থিতির মূল হোতা কারা– এ প্রশ্ন দেশীয় প্রেক্ষাপটে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। ঘটনাস্থলেই আততায়ীকে আটক করা হয়েছে, যিনি ৭১ বছর বয়সী একজন কবি ও লেখক। এখনও ঘটনা পুরোপুরি খোলাসা করে বলা মুশকিল। তবে ইতোমধ্যে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্তর্জাতিক তৎপরতা চলছে বলে মনে হয়। 
স্লোভাকিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ইউরোপের কেন্দ্রে।

পেশায় আইনজীবী রবার্ট ফিকো ১৯৬৪ সালে এক কর্মজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুতিনের মতো তিনিও বডি বিল্ডিং বা শরীর গঠনে বেশ মনোযোগী। ১৯৮৯ সালে ভেলভেট বিপ্লবের আগে আগে তিনি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, যখন পুরোনো চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে পড়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।  

পেশাজীবনে ফিকো দেশি-বিদেশি অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ২০০৯ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও জোট গঠন করতে পারেননি। তবে ২০১২ সালে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। এর পর ২০১৬ সালে জয়লাভের পরও এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক দম্পতি হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তাঁর বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। ফলে ক্ষমতার দুই বছর পর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিক দম্পতি দেশটির শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ইতালির মাফিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। গত তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি একই সঙ্গে যেমন জাতীয়তাবাদী, তেমনি প্রধান সারির ইউরোপপন্থি হলেও ইউরোপবিরোধী ও পাশ্চাত্যবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। এসব কারণে তিনি পাশ্চাত্য মোড়লদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। বিশেষত চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে তাঁর সুস্পষ্ট মস্কোপন্থি অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ওপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। 

ফিকো স্পষ্ট করে বলেছেন, পুতিনের ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের আটকাদেশ ঠেকিয়ে তাঁকে নিজ দেশে আশ্রয় দেবেন। এ ছাড়া তিনি হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের পক্ষে কথা বলেছেন, যিনি মস্কো ও চীনপন্থি। এক সপ্তাহ আগে শি জিনপিং চীন ও ইউরোপ সম্পর্কে অরবানের মডেলের প্রশংসা করেন। মূলত ফিকো পাশ্চাত্যবিরোধী অবস্থানকে চাঙ্গা করতে চেয়েছেন। এবারের নির্বাচনেও তিনি মস্কোপন্থি ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে নিজের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। 

বিশ্বনেতারা ইতোমধ্যে তাঁর ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জো বাইডেন থেকে শুরু করে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন এ হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। এ নিয়ে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। 

বিশ্বনেতারা নতুন করে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা দেখছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষার্থীদের ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন চলছে। এমন অবস্থায় স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর ওপর এই হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের নেতৃত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাপী তারা যে উদারনৈতিক ব্যবস্থার প্রপাগান্ডা চালিয়েছেন, তা স্পষ্টত এখন হুমকির মুখে। যদি কোনোভাবে প্রমাণিত হয়– রবার্ট ফিকোর ওপর হামলার পেছনে পশ্চিমাদের ইন্ধন আছে, তাহলে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী তৎপরতা আবারও উদোম হয়ে যাবে। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহ-সম্পাদক, সমকাল
[email protected]

আরও পড়ুন

×