ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ফিরে দেখা

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: প্রথম বছর কেমন ছিল?

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: প্রথম বছর কেমন ছিল?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আসিফ কবীর

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ০০:৫৬

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে শরণার্থী জীবন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ছোট বোন শেখ রেহানাসহ ব্রাসেলসে ছিলেন। এর পর স্বামী-সন্তান, বোনসহ জার্মানি হয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। দিল্লিতে থাকা অবস্থায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি।

১২ মে ১৯৮১, সদ্য নির্বাচিত সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ঢাকায় আনতে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কোরবান আলী ও আব্দুস সামাদ আজাদ নয়াদিল্লি যান। তাঁর আগমন উপলক্ষে গণসংবর্ধনার প্রস্তুতি হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও রিকশা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। দেশে ফেরার প্রাক্কালে ১৫ মে দিল্লিতে সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার মৌলিক পথনির্দেশের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। ... নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি তিনি ও তাঁর বোন কৃতজ্ঞ। 

১৭ মে ঢাকায় নেমে শেরেবাংলা নগরে বিপুল সংবর্ধনা-উত্তর জনসভায় আবেগমথিত ভাষায় বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। সেদিন প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে অগণন মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ১৯ মে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার কবর জিয়ারত করেন। সেখানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তিনি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মোৎসর্গের প্রতিশ্রুতি দেন।

৪ জুন ঢাকায় দলের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া রক্ষা ও সমুন্নত রাখায় গুরুত্ব আরোপ করেন।

৭ জুন ১৯৮১, ছয় দফা দিবসের আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা সার্বভৌম সংসদ নির্বাচন দাবি করে বলেন, সেনাবাহিনীর হাতে নয়; জনগণের হাতে ক্ষমতা দিন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচার না হলে এ দেশে হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে।

১২ জুন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করা হয়। ১৫ জুন সপ্তাহব্যাপী কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিল শুরু হয়। অবশ্য এর আগে অনুমতি না পেয়ে ৩২ নম্বর সড়কের ফুটপাতেই দোয়া ও মিলাদ আয়োজনে বাধ্য হন তিনি। ১৯ জুন বাড়িটি সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে দেখানোর সময় শেখ হাসিনা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

২১ জুন ময়মনসিংহ, ২৫ জুন রাজশাহী ও ২৮ জুন খুলনায় জনসভা করেন শেখ হাসিনা। ৪ জুলাই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় জিয়া হত্যায় অভিযুক্তদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগদানের আহ্বান জানান। এ ছাড়া ৩ জুন সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী উত্থাপনের প্রতিবাদ করেন।

১৭ জুলাই শেখ হাসিনা লন্ডন যাত্রা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত কমিশনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

৮ আগস্ট দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবি করা হয়। ১০ আগস্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চার দফা পূর্বশর্ত– তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দিদের মুক্তি ও ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবিতে আওয়ামী লীগ রাজধানীতে গণজমায়েত ও বিক্ষোভ মিছিল করে। 

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গৃহীত সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির শেষ দিনে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনা ১৯৭৫ থেকে সংঘটিত সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি শিল্পপতিদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেশের সম্পদ পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। 

১৬ আগস্ট ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় শেখ হাসিনা বলেন, সরকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমস্যা জিইয়ে রাখছে জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ এবং দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল প্রভৃতি সমস্যা অমীমাংসিত রাখছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই। 

২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের আহ্বানে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রথম নির্বাচনী সমাবেশে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান। এর পর ছয় সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, জামালপুর, চট্টগ্রাম, ভোলা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর, পাবনা, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুরে পথসভা, জনসংযোগ ও সমাবেশ করেন। 

২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ (মিজান) অপভ্রংশটি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে একাত্মতা প্রকাশ করে।
৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসে শেখ হাসিনা বলেন, খুনের বদলা খুন দিয়ে হয় না। ১৫ নভেম্বর শেষ নির্বাচনী প্রচারে রাজধানীতে জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, কারচুপি ঠেকাতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁর দল মানুষের সমর্থন ও রায়ের ইঙ্গিত পেয়ে গেছে। 

১৬ নভেম্বর কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগ প্রহসনমূলক নির্বাচন ও ফলাফল মেনে নিতে পারে না। সভায় গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৭ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করে। ২২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা লন্ডন, নেদারল্যান্ডস ও পশ্চিম জার্মানি সফরে যান। 
১৯৮২ সালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করে। ৪ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত না বলে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি বলাই উচিত। 

৭ মার্চ উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। তিনি স্বৈরাচার ও পুঁজিবাদ উৎখাতে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের আহ্বান জানান। ১৭ মার্চ জাতির পিতার ৬৩তম জন্মদিবস উপলক্ষে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরেও রমনা বটমূলে শিশু সমাবেশ, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। সে বছর স্বাধীনতা দিবসেও কোনো কর্মসূচি পালন সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। পাশাপাশি প্রথম বছরটি রাজনৈতিকভাবেও ঘটনাবহুল। ওই সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, আবারও সামরিক শাসন জারি হয়। জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি অবমুক্তকরণ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং তাঁর আদর্শ ও নীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ছাড়াও ওই এক বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিভক্তি লোপ ও সাংগঠনিক বুনিয়াদ দৃঢ় হয়।

আসিফ কবীর: মুজিববর্ষে মিডিয়া কনসালট্যান্ট; ‘জননেত্রীর জয়যাত্রা, খণ্ড ১: ১৯৮১-১৯৯০’ গ্রন্থের সম্পাদক

আরও পড়ুন

×