আন্তর্জাতিক
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তিতে গণবিক্ষোভ কাজে দিয়েছে

মানুষের সংহতি ছাড়া জুলিয়ানের মুক্তি সম্ভব হতো না। ছবি– এএফপি
ক্রিস হ্যাজেস
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪ | ১৩:১৬ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪ | ১৩:৩৮
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অন্ধকারাচ্ছন্ন সাম্রাজ্যের অসততা ও বর্বরতা বিশ্বের সামনে উদোম করে দিয়েছিল। এ কারণে তারা অ্যাসাঞ্জকে ধ্বংস করে দিতে ১৪ বছর চেষ্টা করেছে। তার তহবিল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও ক্রেডিট কার্ড বাতিল করা হয়। সুইডেনে তাকে প্রত্যর্পণ করার জন্য তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের ভূয়া অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেখান থেকে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে।
অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডরে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এরপর তারা নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে তাকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে সাত বছর ধরে আটকে রেখেছিল। তারা ইকুয়েডরে সরকার পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এরই মধ্য দিয়ে তার আশ্রয় প্রত্যাহার করা হয়, দূতাবাসের একজন অনুগত কর্মী তাকে হয়রানি ও অপমান করে। তারা অ্যাসাঞ্জের সকল কথোপকথন রেকর্ড করার জন্য দূতাবাসে স্প্যানিশ নিরাপত্তা সংস্থা ইউসি গ্লোবাল ও তার অ্যাটর্নিদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল।
আজকের সিআইএ তাকে অপহরণ বা হত্যার ব্যাপারে আলোচনা করে। তারা লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশকে ইকুয়েডরের সার্বভৌম অঞ্চল দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করার ব্যবস্থা করে। তাকে পাঁচ বছর ধরে উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এইচএম কারাগার বেলমার্শে বেশির ভাগ সময় নির্জনে আটকে রাখা হয়।
আর সবসময় তারা ব্রিটিশ আদালতে বিচারিক প্রহসন চালিয়েছিল, যেখানে একজন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকের প্রতি যথাযথ প্রক্রিয়া মানা হয়নি। তার প্রকাশনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ছিল না এবং তিনি অন্যান্য সব সাংবাদিকদের মতো হুইসেলব্লোয়ারদের কাছ থেকে নথি পেয়েছিলেন। এ কারণে তাকে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা যেতে পারে।
তারা তাকে ধ্বংস করার জন্য বারবার চেষ্টা করেছে। তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু জুলিয়ানকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। কারণ আদালত আইনের শাসন রক্ষা করেছে এবং এমন একজন ব্যক্তিকে অব্যাহতি দিয়েছে যে অপরাধ করেনি। বাইডেনের হোয়াইট হাউস ও গোয়েন্দাদের বিবেক আছে বলেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। তাকে মুক্তি এই কারণেও দেওয়া হয়নি যে, সংবাদ সংস্থাগুলো মার্কিন সরকারকে চাপ দিয়েছিল। বরং সংস্থাগুলো তার সরবরাহকৃ গোপন নথিগুলো ছাপিয়ে দিয়ে তাকে তারা ছুঁড়ে ফেলেছিল ও তার বিরুদ্ধে জঘন্য রকমের শ্লীলতাহানিমূলক প্রচারণা চালিয়েছিল।
আদালতের নথি অনুসারে, মার্কিন বিচার বিভাগের আবেদন মঞ্জুর করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এই জন্য যে, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর, আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকের কারাবরণ করার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে কয়েক হাজার মানুষ আন্দোলন করেছে। এই সংহতি ছাড়া জুলিয়ানের মুক্তি হতো না।
গণবিক্ষোভ সবসময় কাজ করে না। ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গাজায় গণহত্যা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মুমিয়া আবু-জামাল এখনও পেনসিলভানিয়া কারাগারে বন্দী। জীবাশ্ম জ্বালানীশিল্প গ্রহকে ধ্বংস করে। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হল অত্যাচার থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করা।
এই দীর্ঘস্থায়ী চাপ অন্যায়ের ব্যাপারে নিরবিচ্ছিন্ন মনোযোগ তৈরি করে এবং শাসকশ্রেণির অনৈতিকতা উদোম করে দিয়েছিল। ২০২০ সালে লন্ডনে ওল্ড বেইলি কোর্টে জেলাজজ ভেনেসা বারাইটসার অ্যাসাঞ্জের মামলার শুনানি পরিচালনা করছিলেন। এ সময় আদালতের বাইরে রাস্তার প্রতিবাদকারীদের বিক্ষোভ নিয়ে তিনি অভিযোগ করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। এ কারণে ব্রিটিশ আদালতে স্থান এত সীমিত ছিল এবং ঝাপসা দৃষ্টিসম্পন্ন কর্মীরা সম্মানিত সাংবাদিকদের জন্য একটি আসন সুরক্ষিত করতে ভোর ৪টা নাগাদ বাইরে সারিবদ্ধ হয়েছিলেন। আমার স্থানটি নিশ্চিত করেছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ, যার নাম ফ্রাঙ্কো মানজি।
এসব লোক অজ্ঞাত এবং প্রায়ই অপরিচিত। কিন্তু তারা নায়ক। তারা পাহাড় সরিয়ে ফেলে। তারা পার্লামেন্ট ঘেরাও করে। তারা আদালতের বাইরে মুষলধারে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের যেমন ধৈর্য্য ছিল, তেমনি ছিলেন অবিচল। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ দিয়েছিল। তারাই জুলিয়ানকে বাঁচিয়েছে। আশা করি, এই ভয়ঙ্কর কাহিনীর অবসান ঘটলে জুলিয়ান এবং তার পরিবার আমি অস্ট্রেলিয়ায় প্রশান্তি পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। আমরা অবশ্যই তাদের সম্মান করব। তারা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সেদেশের রাজনীতিবিদদের এবং সবশেষে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য লজ্জার মুখোমুখি করেছে। এটি ছিল স্পষ্টত আত্মসমর্পণ। এ নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত।
আমি তার আইনজীবী মাইকেল রাটনারসহ লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে জুলিয়ানের সাথে দেখা করি। আইনজীবী মাইকেল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার আনীত প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে গণবিক্ষোভকে গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি বলে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি আমাদের যুগের মহান নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবীদের মধ্যে একজন। গণবিক্ষোভ না থাকলে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর রাষ্ট্র অত্যাচার চালাতে পারে। এছাড়াও গণবিক্ষোভহীন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র আইনের প্রতি অবজ্ঞা করে এবং গোপনে অপরাধ সংঘটিত করতে পারে।
জেনিফার রবিনসন, স্টেলা অ্যাসাঞ্জ, উইকিলিকসের সম্পাদকীয় বোর্ডের প্রধান ক্রিস্টেন হ্রাফনসন, নিলস মেলজার, ক্রেগ মারে, রজার ওয়াটার্স, আই ওয়েইউই, জন পিলগার এবং জুলিয়ানের বাবা জন শিপটন এবং ভাই গ্যাব্রিয়েলের সাথে মাইকেলের মতো লোকেরা এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাদের পক্ষে একা এসব করা সম্ভব ছিল না।
আমাদের জন্য গণআন্দোলন অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু সংকট হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ইয়েমেন ছাড়া বাকি বিশ্ব একটি লাইভ স্ট্রিমে গণহত্যা দেখে নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। বিবেকহীন লোভীরা সীমাহীন পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটিয়েই যাচ্ছে। তারা মানুষ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক জগতের সবকিছু এমনভাবে পণ্যে পরিণত করেছে, যা নিঃশ্বেস বা পতন না হওয়া পর্যন্ত শোষিত হতেই থাকবে। নাগরিক স্বাধীনতার অধপতন আমাদেরকে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। যেমন জুলিয়ান সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া আন্তঃসংযুক্ত নিরাপত্তা ও নজরদারির যন্ত্রপাতির ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছিলেন।
বিশ্বের শাসক শ্রেণি তার হাত দেখিয়েছে। এটি গ্লোবাল নর্থে জলবায়ু দুর্গ তৈরি করতে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণে তার শিল্প অস্ত্রগুলিকে তালাবদ্ধ করতে এবং যেভাবে ফিলিস্তিনিদের জবাই করছে মরিয়াদের বধ করতে ব্যবহার করতে চায়।
রাষ্ট্রীয় নজরদারি অতীতের সর্বগ্রাসী শাসন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি অনুপ্রবেশকারী। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সমালোচক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের সহজেই প্রান্তিক বা নীরব করা যায়। রাজনৈতিক দার্শনিক শেলডন উলিন এই সর্বগ্রাসী কাঠামোকে ‘ইনভার্টেড টোটালিটারিয়ানিজম’ বলেছেন, যা বিভিন্ন স্তরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অ্যাসাঞ্জ এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছিল। ক্ষমতা কাঠামো বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর হুমকি টের পায়, যা তাদের দুর্নীতি, অশ্লীল মাত্রায় সম্পদের জমিয়ে রাখা, একের পর এক যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া, অযোগ্যতা ও দমন-পীড়নকে প্রত্যাখ্যান করে। এই বিষদাঁত অ্যাসাঞ্জকে কামড় দিয়েছে, যা থেকে আমাদেরও রক্ষা নেই।
পাইকারিহারে নজরদারির লক্ষ্য কি? যেমন হান্না আরেন্ড তার ‘দ্য অরিজিনস অফ টোটালিটারিয়ানিজম’ এ লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত নজরদারির উদ্দেশ্য অপরাধ আবিষ্কার করা নয়; ‘বরং যখন সরকার জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন যাতে তারা তাদের হাতের নাগালে থাকা।’ এ কারণে আমাদের ইমেল, ফোন কথোপকথন, ওয়েব অনুসন্ধান ও ভূরাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সরকারি ডাটাবেসে চিরকালের জন্য রেকর্ড ও সংরক্ষণ করা হয়। মানব ইতিহাসে আমাদেরই সর্বাধিক ছবি তোলা হয় এবং জনসংখ্যা হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয়েছে। তাই আমাদের জব্দ করার জন্য যথেষ্ট ‘প্রমাণ’ থাকবে। রাষ্ট্র এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। এই অবিরাম নজরদারি ও ব্যক্তিগত তথ্য আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে সরকারি ভল্টের ভিতরে একটি মারাত্মক ভাইরাসের মতো অপেক্ষা করছে। তথ্যটি কতটা তুচ্ছ বা নির্দোষ তা বিবেচ্য নয়। সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার সত্যের মতো অপ্রাসঙ্গিক।
সব ধরনের টোটালিটারিয়ান তথা নিরঙ্কুশ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল বন্দী জনগোষ্ঠীকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। নাগরিকরা তাদের নিপীড়িত কাঠামোর নিরাপত্তা চায়। জুলিয়ানের মতো বশে আনা যায় না এমন বিদ্রোহীদের জন্য কারাবাস, নির্যাতন ও হত্যার ব্যবস্থা রাখা হয়। হান্না আরেন্ট লিখেছেন, এই রাষ্ট্র মানুষের স্বাভাবিক উদ্দীপনাকে ও স্বাধীনতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে এই নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করেছে। জনগণকে ট্রমা দ্বারা স্থবির করে দেওয়া হয়। আইন প্রণয়ন সংস্থাগুলো সাথে আদালত রাষ্ট্রীয় অপরাধকে বৈধতা দেয়। অ্যাসাঞ্জকে নির্বাসনে দিতে গিয়ে আমরা এসব তৎপরতা দেখেছি। এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি অশুভ বার্তা।
আমাদের উন্মুক্ত সমাজ পুনরুদ্ধার করতে হলে এবং আমাদের গ্রহকে বাঁচাতে হলে কর্পোরেট রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে হবে। এর নিরাপত্তাবেষ্টনি ভেঙে দিতে হবে। মান্ডারিন তথা সরকারি, বেসরকারি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী যেসব ব্যক্তিরা সর্বগ্রাসী কর্পোরেট ব্যবস্থা পরিচালনা করে তাদের অবশ্যই ক্ষমতার মন্দির থেকে হঠিয়ে দিতে হবে। এসব মান্ডারিনদের মধ্যে রয়েছে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা, ভন্ড শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত এবং একটি দেউলিয়া মিডিয়া।
রাস্তার গণবিক্ষোভ ও দিনের পর দিন আইন অমান্যই আমাদের একমাত্র ভরসা। উঠে দাঁড়াতে ব্যর্থতাই আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখবে, যা কর্পোরেট রাষ্ট্র সেটাই কামনা করছে। আর পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। জুলিয়ানকে বাঁচাতে ১৪ বছর ধরে রাস্তায় নেমে আসা সাহসী নর-নারীদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া যাক। তারাই আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে এটা করা যায়।
ক্রিস হ্যাজেস: প্রখ্যাত সাংবাদিক; দ্য ক্রিস হ্যাজেস রিপোর্ট থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
- বিষয় :
- জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
- মুক্তি