ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি

ক্ষমা করো মাকিদ হায়দার

ক্ষমা করো মাকিদ হায়দার

মাকিদ হায়দার

হরিপদ দত্ত

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪ | ১৮:৪৯

আমি ক্ষমা চাইছি এমন একজনের কাছে, যে আজ দুনিয়ার জমিনে নেই। চলে গেছে মানুষটা। আমার সহপাঠী বন্ধু। আমি ক্ষমা চাইছি তার কন্যার কাছে। বারবার কথা দিয়েও মেয়েটাকে একনজর চোখের দেখা দেখতে পারিনি। যতবার আমি মাকিদকে ফোন করেছি ততবারই ওই মেয়ে ফোন ধরত। বলত, ‘কাকু, কবে তুমি আমাকে দেখতে আসবে?’ মেয়েটার সামনে দাঁড়ালে আমার কষ্ট হবে– এই ভয়টা তো ছিলই। আর ছিল বাসার দূরত্ব। কোথায় ধানমন্ডি এরিয়া, কোথায় বা ওই দূরের উত্তরা। 

মাকিদ বলত, ‘পঁচিশটা বৎসর একটা মেয়ে বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দেয়। বল তো দত্ত, পিতা হয়ে এটা মেনে নেওয়া যায়?’ উত্তর ছিল আমার– ‘না।’ মনে আছে, বলেছিলাম, ‘কাঁদিসনি মাকিদ, আমি তো ঈশ্বর নইরে ভাই! কী করতে পারি মেয়েটার জন্য?’

আমি জানি, আমি ঈশ্বর, ভগবান নই; রোগ-শোক, মৃত্যুর অধীন অতি নগণ্য একজন মানুষ। কিন্তু এ কথা আজ বারবার মনে পড়ে। মাকিদ বলেছিল, ‘আমি মরে গেলে আমার মেয়েটার কী হবে?’ এর উত্তর আমার জানা ছিল না। সংসারের অনেক কিছুর উত্তর মানুষের জানা থাকে না। আমি ঈশ্বরের কথা তথা খোদার কথা বলতে পারতাম। বলিনি। একটি পুরোনো কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। মানুষ তো পুরোনো কথাটাই বলে বারবার। 

মাকিদের মৃত্যু সংবাদ বাবলা ভাই আমার ছেলের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। আমার মোবাইলে সেই সুবিধে নেই। হকচকিত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যাবে কে? সহপাঠী বুলবুল চলে গেল, পেছনে মাকিদও। তার পেছনে কে? আমি কি? কেউ চলে গেছে বলে কারও কিছু আসে-যায় না। ক্ষতিটা প্রিয়জনের। মৃত্যুর বোঝা তাদেরই বইতে হয়। মাকিদের যে মেয়ে তার নিজের বোঝাই বইতে অক্ষম, সে কীভাবে জন্মদাতার মৃত্যুর বোঝা বইবে? গত বইমেলায় ঢাকায় মাকিদের অনুজ কবি জাহিদ হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মাকিদের কথা জানতে চেয়েছিলাম। সংক্ষেপে জেনেও নিই। 

আমার দুঃখ আর যন্ত্রণা এখানেই যে, মেলায় মাকিদের সঙ্গে দেখা হয়নি। তার সঙ্গে শেষ দেখা আমার এই বইমেলায়ই, অন্তত ৪-১৫ বছর আগে। চাকরিতে অবসর নিয়েছে মাকিদ। বয়স হয়েছে আমারই মতো। মাকিদ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ। তার কবিতায় স্মৃতি হয়ে এসেছে তার জন্মভূমি পাবনা, তার অতীত-বর্তমান। তার রাজনৈতিক কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের সমকাল। 

ছাত্রজীবনে পায়জামা আর হাফ শার্ট পরা আমার সহপাঠী মাকিদকে আমি যখন মতিঝিলে তার অফিসে দেখতাম, তখন সে অন্য মানুষ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার ফাইন্যান্স ডিরেক্টর। বড় আমলা। গল্প হতো বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে সরকারি টাকায়। আমি আরামবাগে পরিবার নিয়ে থাকতাম। ধানমন্ডির কোনো এক স্কুলের ছাপোষা মাস্টার মশাই (শিক্ষক)। আসা-যাওয়ার পথে মাকিদের অফিসে ঢুঁ মারা। হয়তো কোনো দিন কথা হতো কলেজ জীবনের শাঁখারীবাজার-তাঁতীবাজারের সহপাঠিনীদের নিয়ে। হতো বাংলা শিক্ষক অজিত গুহের কথা, ইংরেজির শিক্ষক মতি স্যারের কথা। শওকত আলী তো ছিলেনই। 
সেই মাকিদ হায়দার চলেই গেল। আমাদের বাল্যস্মৃতির সময়ে আমরা কেউ কবিও ছিলাম না; কথাসাহিত্যিকও না। ওই যে কিছুই ছিলাম না যে বয়স বা সময়টায়, সেটাই ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সংসারের দায় ছিল না, জীবনের দায় ছিল না, বটবৃক্ষের মতো উঁচু হবো– এমন স্বার্থবাদী ভাবনাও ছিল না। সময়ের আগে আগে দৌড়াতাম। সেই দৌড় থামিয়ে চলে গেল মাকিদ। কার কাছে সঁপে দিয়ে গেল তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে? সেই মেয়েকে আজও আমার দেখা হলো না। সামনে দাঁড়াতে যে বড় ভয়, বড় ভয়।

হরিপদ দত্ত: কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন

×