ভূরাজনীতি
বাংলাদেশ এখন কোন বলয়ে যাবে?

যোবায়ের আল মাহমুদ
যোবায়ের আল মাহমুদ
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:২১ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:২১
কেউ কেউ বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে ঢুকে পড়ছে এবং তা প্রতিহত করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আসলে কোন বলয়ে যাব? গত ৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে আয়োজিত শিক্ষক সমাবেশে আমি বলেছিলাম, এই গণঅভ্যুত্থান একান্তই এ দেশের জনগণের, এখানে পরাশক্তির তেমন সমর্থন আমরা পাইনি। হত্যাযজ্ঞের মুখেও এ দেশের ছাত্র-জনতাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, পরাশক্তিদের থেকে ‘লিপ সার্ভিস’ পর্যন্ত ঠিকমতো আমরা পাইনি। আন্দোলন সফল হলে পার্শ্ববর্তী ও দূরবর্তী দেশের কোনো এজেন্সির ক্ষমতা কাঠামো দখল আমরা প্রতিহত করব। আমরা উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক বাংলাদেশ গড়ব।
গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে; কিন্তু কোনো বলয়ে না যাওয়ার গণআকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেই প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতনের পর দেখা গেল নানা এজেন্সির দৌড়ঝাঁপ। তাদের তৎপরতায় গঠিত হলো ‘সুশীল লিবারেল সরকার’। গণঅভ্যুত্থানের পর যেখানে সংবিধান রহিত, বিপ্লবী সরকার ও বিপ্লবী পরিষদ গঠন, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, নতুন সংবিধান রচনার দিকে যাওয়া দরকার ছিল; সেখানে বিদ্যমান কাঠামোর সংস্কার করে গণআকাঙ্ক্ষাকে আবারও দমিয়ে দেওয়ার কৌশলী রাজনীতি শুরু হয়েছে। ফলে ২০২৪ সালে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের গঠিত করে নিজেদের রাষ্ট্র নিজেরাই গড়ার যে সুযোগ আবারও এসেছে, তা অনেকটাই কঠিন হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন যে বাংলাদেশ কোন বলয়ে যাবে।
বাংলাদেশের প্রধান সংকট আসলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে এ দেশের জনগণের কাজ করতে না পারা বা বিকাশ না হওয়া। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের পুনর্গঠন করতে না পারলে বাইরের বলয়মুক্ত থেকে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই বিলম্বে হলেও আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান যেমন অভ্যন্তরীণ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, তেমনি ছিল ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। আবার চীন ও রাশিয়াও বিগত তিনটা একতরফা নির্বাচনে হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে এ দেশের নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। চীন ও রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে বাংলাদেশের স্বৈরশাসন অনুপ্রেরণাও পেয়েছে।
বাংলাদেশের বামপন্থিরা রাশিয়া ও চীনের দিকে এক ধরনের রাজনৈতিক ঝোঁক অনুভব করেন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের প্রতি মতাদর্শিক টানের কারণে। সেই ভাবাদর্শ থেকে চীন বা রাশিয়া বলয়ে বাংলাদেশকে রাখার ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরেন। আবার দুনিয়াজুড়ে আমেরিকার ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিন নীতির কারণেও এখানে মার্কিন বলয়বিরোধী চেতনা কাজ করে। তবে এসব দিক মাথায় রেখেও এ দেশের জনগণ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমেরিকার সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষত গুম-খুন-মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীর বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি মার্কিন নীতিকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ ধনাত্মকভাবেই নিয়েছে। যেহেতু গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাই ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের মার্কিন বলয়ে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা দুনিয়ার কাছ থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন ও সহায়তা পেতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করেছিল ছাত্র-জনতা। পশ্চিমা লিবারেল বুর্জোয়া সিস্টেমের ব্যাপারে প্রফেসর ইউনূসের পক্ষপাতের কারণেও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বাভাবিক পরিণতি হবে মার্কিন বলয়ে অধিক মাত্রায় ঝুঁকে পড়া। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা ছাড়া আমাদের কি অন্য কোনো উপায় আছে? উত্তর, সম্ভবত না।
আবার আগের সরকারগুলো কি মার্কিন বলয়ের বাইরে ছিল? তার উত্তরও– না। কারণ আগের সরকারকেও আইএমএফ থেকে বিপুল ঋণ নিতে হয়েছে অনেক শর্ত মেনে। এমনকি যে ‘ওয়ান ইলেভেন’ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় আনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, সেটাও আমেরিকা ও ভারতের যৌথ সমর্থনে সংঘটিত হয়েছিল বলে অনেকের মত।
কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারে মার্কিন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও নীতি অনুসরণ যুক্তিসংগত হলেও তাদের অন্যায্য অর্থনৈতিক সুপারিশ ও আন্তর্জাতিক অন্যায্য নীতি মানা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। যেমন আইএমএফ আবারও দেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সার খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। এটা মেনে নিলে জিনিসপত্রের দাম ও উৎপাদন খরচ বাড়বে, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সব আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে আমরা সব সময় একমতও হতে পারব না। যদিও চ্যালেঞ্জিং, আমাদের স্বকীয় অবস্থান বজায় রাখতেই হবে।
২০২৪ সালে সমাজতান্ত্রিক বা মাওবাদী বিপ্লবও হয়নি যে, আমাদের রাশিয়া বা চীনা ব্লকে যেতে হবে। আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। ফলে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে যেতে হলে লিবারেল ও কল্যাণমূলক কাঠামোর দিকেও যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে চারটা পথ খোলা আছে আমাদের সামনে– ক. ইউরোপিয়ান কল্যাণমূলক কাঠামো মডেল; খ. মার্কিন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মডেল; গ. মার্কিন ও ইউরোপিয়ান হাইব্রিড মডেল; ঘ. গ্লোবাল গণতান্ত্রিক মডেলের বাংলাদেশি ভার্সন বা লোকায়ত গণতান্ত্রিক কাঠামো।
সমস্যা হচ্ছে, লোকায়ত গণতান্ত্রিক কাঠামো হাজির করার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক স্কিল দরকার, সেটার ঘাটতি আছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে। আবার ফ্রেন্স সেক্যুলারিজমের বর্তমান ভার্সন বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর কাছে সমাদৃত হলেও আমার মতে, মার্কিন উদারনৈতিক সেক্যুলার গণতান্ত্রিক কাঠামো আমাদের জন্য বেশি উপযোগী। কারণ মার্কিন ভার্সনে নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যক্তির বিকাশের যে সামগ্রিক বন্দোবস্ত আছে, তা বেশি প্রায়োগিক ও গণতান্ত্রিক। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মডেলের ভিত্তিতে আমাদের এগোনোই বেশি বাস্তবসম্মত।
প্রশ্ন হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মডেল কীভাবে আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিনির্মাণে সহায়ক হতে পারে? আমি মনে করি, যে সংবিধান দেশে ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ চালু রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, সেটির মৌলিক পরিবর্তনই হবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ। সে ক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধান কীভাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা, মর্যাদা, মানবাধিকার, সিভিল রাইটস সুরক্ষার জন্য সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
অবশ্য মার্কিন গণতান্ত্রিক মডেলের সঙ্গে যদি আমরা ইউরোপিয়ান কল্যাণমূলক রাষ্ট্রকাঠামোর সংশ্লেষণ হাজির করতে পারি, সেটিই এ মুহূর্তে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু মার্কিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নিওলিবারেলিজমের যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিষক্রিয়া রয়েছে, যেমন– শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও পণ্যকরণের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থের চেয়ে এলিট শ্রেণির স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার মতো গণবিরোধী নীতি বাদ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার মানে এই না যে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন বলয়ে চালিত হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতে হবে। সে জন্য আবারও গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে আমরা নিজেদের কতটা গড়তে পারি। কারণ এর ওপর নির্ভর করবে আমরা কীভাবে পরাশক্তির সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্ক রক্ষা করে নিজেদের স্বাধীন জাতিসত্তার পরিচয় দিতে পারব।
ড. যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- ভূরাজনীতি