অন্যদৃষ্টি
শিশুর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি
মো. রমজান আলী ও রাজু দাশ
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫ | ০০:১৩ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ | ০৬:০০
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণত একাডেমিক দক্ষতা এবং পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থাকে। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাব শিশুর শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং পরিণত বয়সে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন, শরীর ও মনের সুস্থতা, স্বাভাবিক বিকাশ, নিজের আবেগ সঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারা, অন্যের আবেগ বুঝতে ব্যর্থ হওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা, কর্মজীবনে ব্যর্থতা এবং সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি।
বিশেষভাবে, ছোটবেলা থেকে যদি শিশুর আবেগীয় দক্ষতার সঠিক বিকাশ না হয় বা আবেগীয় দক্ষতা শেখানো না হয়, তবে তাদের জন্য বিদ্যালয়ে আশানুরূপ ফলাফল করা, পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়া এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মূল ভিত্তি পরীক্ষার ফলাফল, সেখানে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাব তাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বলতে নিজের ও অন্যের আবেগ চিহ্নিত করা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং ব্যবস্থাপনার দক্ষতাকে বোঝায়। এটি পাঁচটি মূল উপাদানের মাধ্যমে গঠিত: আত্মসচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহমর্মিতা, সামাজিক দক্ষতা এবং অনুপ্রেরণা। যেসব শিশু ছোটবেলা থেকে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা শেখে, তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, চাপ সামলাতে পারে এবং সুস্থ সামাজিক জীবনযাপন করতে পারে। যারা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা শেখে না, তারা সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
বাংলাদেশে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ ও কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে অনেক ক্ষেত্রে আবেগ প্রকাশকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়, যা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, অনেক অভিভাবক আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন, ফলে শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বাড়াতে তারা সহযোগিতা করতে পারেন না।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত সময় হতে পারে একাডেমিক পরীক্ষার আগে ও পরে বা দুই পরীক্ষার মাঝে, পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে অথবা খেলাধুলার সময় যখন শিক্ষার্থীরা এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে গুরুতর খারাপ প্রভাব ফেলে। যেমন, ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সারাদেশে ৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে এবং আরও ৩ জন শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনা হয়তো এক দিনের খবর, কিন্তু এর সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি হতে পারে।
এ ছাড়া, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কম থাকলে সহপাঠীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা যদি আবেগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়, তারা সহজেই সহপাঠীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে অথবা দলগত কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না, যা ভবিষ্যতে তাদের কর্মজীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত উদ্বেগে ভোগে, যা তাদের ফলাফলকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপ ভালোভাবে সামলাতে পারে এবং ভালো ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়।
শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাই জীবনের একমাত্র সফলতার মানদণ্ড হওয়া কাম্য নয়। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সুখী ও সফল হওয়ার মানদণ্ডের অন্যতম একটি সূচক। তাই শিশুকে ছোটবেলা থেকেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সহমর্মিতা এবং সম্পর্কের গুরুত্ব শেখানো এবং চর্চা করানো উচিত।
মো. রমজান আলী: প্রোগ্রাম অফিসার ফর এডুকেশন, ইউনেস্কো ও রাজু দাশ: প্রোগ্রাম অফিসার
ফর এডুকেশন-হেলথ অ্যান্ড
ওয়েলবিং, ইউনেস্কো
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- শিশু
- বিকাশ