দিবস
শরণার্থী সংকট দূর করতে সংহতি

এম এ হালিম
এম এ হালিম
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০০:৪৪
শরণার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে জাতিসংঘ ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সলিডারিটি উইথ রিফিউজিস তথা শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি’। এটি শরণার্থীদের অধিকার, মর্যাদা, জীবিকা ও প্রত্যাবাসন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। শরণার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ রিফিউজি কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়, যদিও তখনকার উদ্যোগ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউরোপীয় শরণার্থীদের স্বার্থকেন্দ্রিক। ১৯৬৭ সালে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই কনভেনশনকে সর্বজনীন করা হয়।
কনভেনশন অনুসারে শরণার্থীরা ১০টি অধিকারভোগী– বহিষ্কৃত না হওয়া; অনুপ্রবেশের জন্য শাস্তিভোগ না করা; কাজ করার অধিকার; আশ্রয়, শিক্ষা, ত্রাণ ও সহযোগিতাপ্রাপ্তি; ধর্ম পালনের স্বাধীনতা; আইনগত সুবিধা; দেশের অভ্যন্তরে অবাধ চলাচল সুবিধা এবং পরিচিতি ও ভ্রমণ দলিলপ্রাপ্তি। বাংলাদেশ রিফিউজি কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি বিধায় এর কিছু শর্ত মানতে বাধ্য নয়।
বিশ্বের সর্বাধিক শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরান (৩৫ লাখ), তুরস্ক (২৯ লাখ), কলম্বিয়া (২৮ লাখ), জার্মানি (২৭ লাখ) ও উগান্ডা (১৮ লাখ)। বাংলাদেশও ২০১৬-১৭ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে অনুপ্রবেশকারী ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ১৯৯১-৯২ সময়ে অনুপ্রবেশকারী ২ লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা একটা উল্লেখ্যযোগ্য অংশ এখনও ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এর সঙ্গে প্রতিবছর গড়ে ৩৫ হাজার নতুন জন্মসহ সব মিলিয়ে রোহিঙ্গার বর্তমান সংখ্যা ১৩ লক্ষাধিক বলে উল্লেখ করা হয়।
শরণার্থীরা এক মানবেতর জীবন বয়ে চলে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কার্যক্রম এবং পাকিস্তানের কোয়েটায় আফগান শরণার্থী ক্যাম্পে আমার কাজের অভিজ্ঞতায় শরণার্থীদের দুরবস্থা কাছে থেকে অনুধাবন করেছি। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবর্জিত ও মনো-সামাজিক অধিকারবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের অলস ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমার মতো অনেককেই ব্যতীত করেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দ্বদ্ব ও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তহবিল সংকটের কারণে শিশুসহ সব বয়সের শরণার্থীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ বাস্তবিক কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকৃত। ইউএনএইচসিআর বলছে, গত এক দশকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ। অথচ সংস্থাটির মানবিক তহবিল এখনও ২০১৫ সালের মতো রয়ে গেছে। ফলে চলমান ব্যয় সংকোচন শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুতদের আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
শরণার্থীদের আশ্রয় দানকারী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও এক বাস্তবতা। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, স্থানীয়-বহিরাগত দ্বন্দ্ব, এমন অনেক ঘটনা ঘটে। রোহিঙ্গা অবস্থানের ফলে বাংলাদেশও এমন অনেক অভিজ্ঞতার শিকার। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রায়ই সহিংসতা ও সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত, চোরাচালানে সহযোগিতা, অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দুর্নাম ঘটাচ্ছে। জানা যায়, ৩৩টি ক্যাম্পে অন্তত ১২টি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। বুধবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের এসব সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে। এ উদ্যোগ চলমান থাকলে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিবেশ বিঘ্নিত হবে এবং স্থানীয় পরিবেশ অশান্ত করবে। কেননা, ধরে নেওয়া যায় এর সঙ্গে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলও সম্পৃক্ত হবে। অন্যদিকে তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ক্রমশ সীমিত হচ্ছে। ৯ জুন ইউনিসেফ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তহবিল সংকটের কারণে ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষককে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ৪ সহস্রাধিক লার্নিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে এবং ২ লাখ ৩০ হাজার শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেছেন, ‘আমরা এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক অস্থির সময়ে বাস করছি, যেখানে আধুনিক যুদ্ধ এক ভঙ্গুর ও মর্মান্তিক মানবিক সংকট তৈরি করেছে। শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের আরও বেশি প্রচেষ্টা দরকার।’
গ্রান্ডির এই আহ্বান প্রসারিত না হতেই শুরু হয়েছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট তেহরানের জনগণকে রাজধানী ছাড়তে বলেছেন। ইরানও তেল আবিব এবং হাইফারের বেসামরিক জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরতে বলেছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী হলে শরণার্থীর সংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে, অনুমান করা কঠিন নয়।
যুদ্ধ কোনো সমাধান বয়ে আনে না– এ অমর সত্য বিশ্বের সব পক্ষ বিশ্বাস করলেও যুদ্ধকে জিইয়ে রাখতে যেন চেষ্টার অন্ত নেই। কারণ যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বাণিজ্য তত রমরমা হবে। পাশাপাশি সংলাপের নামে মারণাস্ত্র উৎপাদকদের দৌড়ঝাঁপ চলবে। তাই বিশ্বে যুদ্ধ যেমন থামছে না, তেমনি শরণার্থী সমস্যাও রয়ে যাচ্ছে সমাধানের অন্তরালে। ইউএনএইচসিআর বলছে, গত এক দশকে প্রতিবছর শরণার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রধান কারণ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও সংঘাত এবং তা থামাতে বৈশ্বিক ব্যর্থতা। তাই তো গেল শতকের নব্বই দশক থেকে শুনছি আফগান শরণার্থীর করুণ কাহিনি। আফ্রিকার শরণার্থী প্রসঙ্গ তারও আগে থেকে। আর এ শতকে শান্ত মধ্যপ্রাচ্যেও শরণার্থীর ভিড় কেবলই বাড়ছে। সব রাষ্ট্রের অভিভাবক জাতিসংঘ অথবা আঞ্চলিক জোটগুলো (ইইউ, আরব লিগ, আফ্রিকান জোট, আসিয়ান ইত্যাদি) যেন শুধু প্রস্তাব পাস আর বিবিৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তাই প্রয়োজন এখন সত্যিকার ভূরাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক আইন অথবা কনভেনশন প্রতিপালনে দৃঢ় অঙ্গীকার। তবেই সম্ভব হবে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার সমাধান এবং তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা, যা কিনা বিশ্ব শরণার্থী দিবসের তাৎপর্য।
এম এ হালিম: সাবেক পরিচালক,
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
- বিষয় :
- দিবস