অন্যদৃষ্টি
বাস্তবের প্রকল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

প্রতীকী ছবি
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | ০৩:১৮
সারা দুনিয়ায় প্রযুক্তির নতুন মাত্রা হিসেবে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ক’দিন আগে চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবন শক্তি নিয়ে অন্যান্য বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বেশ আলোচনার ঝড় উঠেছিল। প্রযুক্তির এই নতুন নতুন উদ্ভাবন আমাদের জীবনযাপনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি বহু সংকটেরও সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চ্যাটজিপিটি দিয়ে শত শত গল্প লিখে জমা দেওয়ার প্রমাণ সাপেক্ষে মার্কিন অনলাইন ফ্যান্টাসি ও সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ ও প্রযুক্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে মুখোমুখি হয়ে পড়ছে, এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এআই ব্যবহার করে সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর লক্ষ্য প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো। এ ছাড়া সরকার রাজস্ব ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে, যা শিগগির শুরু হতে পারে।
একদিক থেকে সরকারের এই সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব ও সাধুবাদযোগ্য। একইভাবে এটাও জিজ্ঞাসা, বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে কতটা প্রস্তুত? আমরা হলিউডের অনেক সিনেমায় দেখেছি, যেখানে প্রোটাগনিস্ট বিভিন্ন কৌশলে বিশেষ এক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন, যা ঘটনাচক্রে দানব হয়ে হাজির হয়। একটা পর্যায়ে সেই দানব সৃজনকারীর নিয়ন্ত্রণে আসে কিংবা তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আমরাও এআই ব্যবহার করতে গিয়ে দানবের মুখোমুখি হচ্ছি কিনা?
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খাত এখনও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার বাইরে। এখানে আধুনিক মানে কেবল প্রযুক্তির উৎকর্ষ নয়, বরং আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাও এখানে যুক্ত। কাজকর্মে গতিশীল হওয়া, অব্যবস্থাপনা দূর করা, সক্ষমতা বৃদ্ধি আধুনিকতারই অংশ। কিন্তু আমরা রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে যেভাবে এআই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আদতে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোর ব্যাপারে সচেতন কিনা? যেমন প্রকল্পে এআই ব্যবহার হলে খরচ কমে আসতে পারে এবং কাজের গতিও বাড়তে পারে। একইভাবে তদারকির জন্য যোগ্য ও সক্ষম ব্যক্তি না হলে এআই-নির্ভরতায় উল্টো ফল দেওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া এআই ব্যবহারে জনবল কমে আসবে। এতে কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত সংকট তৈরি হতে পারে। তবে সরকারের এআই ব্যবহারের উদ্দেশ্য কর্মসংস্থানে জনবলের
বদলে প্রযুক্তির স্থানান্তর নয়, বরং বিদ্যমান কাজে প্রধানত গতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
এআই মানুষের মতো বিদ্যমান জ্ঞান দিয়ে সমস্যার মীমাংসা করতে উদ্যোগী হয়।
এআই কম পরিচিত প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল পরামর্শ দেবে। সে যাই হোক, কাজের সক্ষমতা ও গতি বাড়াতে এআই ব্যবহার দেশবাসীর জন্য সুখবর। সে ক্ষেত্রে সরকারকে বাড়তি কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যেমন রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয়গুলোতে এআই ব্যবহার করলে আন্তর্জাতিক নজরদারি সহজ হয়ে উঠতে পারে। খুব সহজে তথ্য পাচারের আশঙ্কাও থেকে যায়।
উন্নত বিশ্বে এআই ব্যবহার এখন মুহূর্তের ঘটনায় রূপ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে যেভাবে ধীরে ধীরে নিজস্ব জ্ঞান সৃজন, শিক্ষা ও উদ্ভাবনের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি বর্তমান পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, সে রকম অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এর মানে, প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় ধরনের একটা উল্লম্ফন আমাদের মধ্যে ঘটছে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে একটা ফাঁপা জায়গা রয়ে যাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো, এআই ব্যবহার করে প্রকল্প খরচ ও কাজের গতি বাড়িয়ে তোলার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি সেটি নিশ্চিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এই সমস্যা আমাদের সেই অভিজ্ঞতাহীন উল্লম্ফনের পরিণতি বলে চিহ্নিত করা যায়।
প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে দুর্বৃত্তায়নের অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতগুলো আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে আনা জরুরি, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি