উল্টোরথ
ঐকমত্যের আলোচনা ও প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে?

এহ্সান মাহমুদ
এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫ | ০১:০৪ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ | ০১:০৫
আ বদুল্লাহ বিন জাহিদ, শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া, মারুফ হোসেন, আফিকুল ইসলাম সাদ, আব্দুল আহাদ সৈকত, ইমাম হাসান ভূঁইয়া তায়িম ও ইয়াসির সরকার ২৬ জুন শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এরা প্রত্যেকেই শহীদ হয়েছে। যাদের বসার কথা ছিল পরীক্ষার টেবিলে, তাদের পড়ার টেবিলেও নেমে এসেছে শতাব্দীর নিস্তব্ধতা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান আমাদের এমন ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ‘বেঁচে থাকলে আজ ওরা পরীক্ষা দিত’ শিরোনামে এই খবরই দিয়েছে প্রথম আলোয়।
রাষ্ট্রে চলছে সংস্কার বনাম নির্বাচনের দ্বৈরথ। এই লড়াই আমাদের জুলাই-আগস্টের শরীর হিম করা পরিস্থিতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হলে ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন গঠনের পর প্রথমে একবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। এখন চলছে দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব বিষয়ে দুই মাস সময় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছিল কমিশন। প্রথম পর্বে যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে এই পর্বে আলোচনা হচ্ছে।
প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে, মোটা দাগে যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে– সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি, ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন) এবং সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি, এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এই আলোচনা কত দিন চলবে, সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়নি।
চলমান আলোচনায় এখনও যেসব বিষয়ে জোর আপত্তি রয়েছে, তার মধ্যে একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ– রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এনসিসি গঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি), পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (পিএসসি) বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগে এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যে কোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়।
এনসিসি গঠনে বিএনপির ঘোর আপত্তি থাকায় নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর বদলে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠিত হবে। এতেও সায় দেয়নি বিএনপি (সমকাল, ২৬ জুন ২০২৫)।
এনসিসি বা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিঃসন্দেহে কমবে। কোন দল এটা সমর্থন করে, কোন দল করে না– এই বিতর্কের বাইরে থেকে বরং প্রশ্ন তোলা যেতে পারে– প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থায় কোন কোন দেশে এই নজির আছে?
চলমান আলোচনায় আরেকটি বিতর্কের বিষয় প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব– এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দু’বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আলোচনায় নতুন প্রস্তাব আসে। তা হলো, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি কতদিন থাকবেন, তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে এনসিসি গঠন হচ্ছে কিনা, সংসদের উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কতটুকু হবে; তাও নির্ধারিত হতে হবে। যেহেতু এসব শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যৌক্তিক হবে না।
সবচেয়ে বড় কথা, যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কতটা ঐকমত্য হবে– সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কিছু দল এখনও নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাই এই আলোচনা ও প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা হলেও সে অনুযায়ী ফল আসছে না।
আশার কথা, যত সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার তুলনায় ফল কম হলেও ঐকমত্য কমিশন আশাবাদী। কমিশনের আশাবাদী হওয়া দেখে পুরোনো বাংলা গান ধার করে বলা যায়– ‘কেন আশা বেঁধে রাখি/ কেন দীপ জ্বেলে রাখি!’
কমিশন যতই আশাবাদী হোক; নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা কতদিন চলবে; আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান হবে কিনা; এসব নিয়ে জনমনে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এখন আলোচনায় যা দেখা যাচ্ছে– কোনো কোনো দল সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো দল নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই দূরত্ব দূর করা কঠিন কাজ; সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকার যেহেতু জেনেশুনে দায়িত্ব নিয়েছে, তাই দ্রুত এর সমাধান করার দায়িত্বও সরকারের।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার প্রস্তাবে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় স্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। এর পেছনে নতুন শক্তি সঞ্চয়, ভোটের হিসাব-নিকাশ কাজ করেছে। যদিও তা হওয়া উচিত ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে যেসব বিষয়ে বেশির ভাগ দল ঐকমত্য প্রকাশ করেছে, সেগুলো নিয়েই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এগিয়ে যেতে হবে। সব বিষয়ে সব দল একমত হবে না– এটা ধরে নিতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা আশা করাও যায় না।
বাংলাদেশে এক সময় বাকশালি ব্যবস্থা ছিল। সেই ধারা থেকে বাংলাদেশ বহু ক্রোশ দূরে এখন দাঁড়িয়ে। ভিন্নমত আছে বলেই সবাই ভিন্ন দল করেছে। মোদ্দাকথা, নির্বাচন করতে গিয়ে সংস্কারকে বাদ দেওয়া যাবে না। আবার সংস্কারের নামে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা যাবে না। এটা তো ঠিক, অনেক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। এ ধরনের সংস্কার সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু এসব বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাই অন্তহীন আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা আসবে কিনা– তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সন্দেহ যখন তৈরি হবে তখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও ফিরে আসবে। এ ধরনের অনিশ্চয়তা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই দেশকে নেতিবাচক প্রভাব
থেকে রক্ষা করার স্বার্থেই নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। নির্বাচন ও সংস্কারকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুযোগ কাউকে গ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- আলোচনা