মুরাদনগরের নৃশংসতা
আইনশৃঙ্খলার অবনতি স্পষ্ট

প্রতীকী ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ | ০০:৪৪
কুমিল্লার মুরাদনগরে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে যেইভাবে দুই সন্তানসহ মাকে গণপ্রহারে হত্যা করা হইয়াছে, উহাতে আমরা ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। মব সহিংসতা প্রতিরোধে বারংবার আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাগিদ দিয়া আসিলেও এইবারের অঘটন যেন পূর্বের সকল মাত্রা অতিক্রম করিয়াছে। মাদক কারবার কিংবা ফোন চুরি– অপরাধ যাহাই হউক না কেন, এই প্রকারে একটি পরিবারের উপর সহস্রাধিক মানুষের আক্রমণ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। যাহা অধিক বেদনার, এই মব সন্ত্রাসের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ। তথায় চেয়ারম্যান ও মেম্বারের উপর হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া এলাকার মসজিদ হইতে মাইকে ঘোষণা দিয়া জনসাধারণকে উত্তেজিত করা হইয়াছে। তাহারা ভুক্তভোগীর বাড়িতে হামলা–ভাঙচুর করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই; তিনজনকে হত্যা করিয়া মরদেহ বাড়ির সম্মুখে ফেলিয়া রাখিয়াই তবে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছে!
এই মব সহিংসতা এক ভয়ানক ব্যাধির নজির। যাহার আস্ফালন গত ১১ মাস ধরিয়া চলমান এবং ইহা কেবল মুরাদনগরে সীমাবদ্ধ নহে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বৎসরের জানুয়ারি হইতে মুরাদনগরের ঘটনা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণপ্রহারের ঘটনায় প্রায় শত মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন। মানুষ কেন স্বীয় হস্তে আইন তুলিয়া লইতেছে? ইহার পশ্চাতের প্রধান কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাষ্ট্র পরিচালিত যে বাহিনীর উপর এই ব্যবস্থা অর্পিত, তাহাদের উপর কেন মানুষ আস্থা রাখিতে পারিতেছে না, উহার কারণ অনুসন্ধান জরুরি।
সরকারের তরফ হইতে মব সন্ত্রাসে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের কথা বলা হইলেও উল্লিখিত অনাচারে সংশ্লিষ্টদের বিচারের দৃষ্টান্ত না থাকিবার কারণে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হইতেছে। মুরাদনগরের ঘটনায় কীরূপে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ন্যায় জনপ্রতিনিধিগণ মব সহিংসতায় অংশ লইলেন? আমরা মনে করি, তাহাদের অবশ্যই জবাবদিহি করিতে হইবে। মসজিদের মাইকই বা কীরূপে এমন সহিংসতার উস্কানিতে ব্যবহৃত হইল? এই ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে দ্রুত শনাক্ত করিয়া আইনের আওতায় আনিতে হইবে। সমকালের খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঐ মব সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসিয়া গুরুতর আহত পরিবারের এক সদস্যকে উদ্ধার করিতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন হইল, উহাদের আগমনে এত বিলম্ব ঘটিল কেন? মঙ্গলবার মোবাইল ফোন চুরি হইতে যেই ঘটনার সূত্রপাত, তাহা যে এত শাখা-প্রশাখা মেলিবে– পুলিশ ধারণা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে কেন? যাহা হউক, আমরা প্রত্যাশা করিব, আহত সদস্যের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হইবে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বলিয়া এলাকাবাসীর সহিত তাহাদের বিরোধ ছিল। তবে কেন তাহাদের আইনের হস্তে সোপর্দ না করিয়া গণপ্রহারে হত্যা করা হইল? ইহা কেবল গুরুতর ফৌজদারি অপরাধই নহে, মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। গণপ্রহার বা মব সহিংসতার নামে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
কোনো ব্যক্তি অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট হইলে তাহার প্রতিকারে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান। উক্ত ব্যবস্থার উপর নাগরিকদের আস্থা রাখিতে হইবে। উহার ব্যত্যয় ঘটিলে মব সহিংসতায় কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই ধ্বংস হইবে না, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হইবে। আমরা মনে করি, জননিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে মব সহিংসতাকে কঠোর হস্তে দমন করা আশু কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার বিকল্প নাই। সরকারের দিক হইতেও তাহাদের প্রতি কঠোর হইবার বার্তা দেওয়ার পরও উহার বাস্তবায়ন না হইবার কারণ খতাইয়া দেখা দরকার। কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলিতে পারে না। নাগরিকদেরও উৎকর্ণ থাকিতে হইবে। কোথাও মব সহিংসতার আভাস পাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ অবহিত করা কিংবা নিজেরাই সংগঠিত হইয়া উক্ত দুষ্কর্মকে রুখিয়া দিতে হইবে।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়