পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে ফের রাজপথে উত্তেজনা

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
কয়েক দিন বিরতির পর ফের রাজপথে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সরকার পতনের এক দফার যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ শুক্রবার রাজধানীতে গণমিছিল করবে বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা। অন্যদিকে, বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে সম্ভাব্য নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস ঠেকাতে মহানগরীতে ‘সতর্ক অবস্থানে’ থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অবশ্য গত কয়েকবারের মতো আওয়ামী লীগের সমাবেশের কর্মসূচি না থাকলেও ১৪ দলের ব্যানারে ‘শান্তি সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হবে। এ পরিস্থিতিতে আবারও কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজপথ। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সহিংস ঘটনার পর আন্দোলনের কর্মসূচিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে বিএনপির। ওই কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতায় লোকসমাগম কম হওয়ায় দায়িত্বশীল নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন দলটির হাইকমান্ড। ওই ঘটনার পর আজ প্রথম যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামছে বিএনপি। রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে দুটি গণমিছিল করবে তারা। দুপুর ২টায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির উদ্যোগে বাড্ডা সুবাস্তু টাওয়ার থেকে আবুল হোটেল পর্যন্ত এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে কমলাপুর থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত এ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির মিত্র দল ও জোটগুলোও আলাদাভাবে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে গণমিছিলের কর্মসূচি পালন করবে।
অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পৃথকভাবে সকাল থেকেই সতর্ক অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে গোটা ঢাকা মহানগরীতে। মহানগরীর দুই অংশের সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটে অবস্থিত দলীয় কার্যালয়গুলোর সামনে সতর্ক অবস্থানে থাকবেন নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের উদ্যোগে আজ বিকেল ৪টায় রাজধানীর উত্তরার আজমপুর আমির কমপ্লেক্সের সামনে ‘শান্তি সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু এমপিসহ জাতীয় নেতারা সমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
দু’দলের আজকের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে সতর্ক থাকবে পুলিশ। এর আগে রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতার ঘটনা ঘটায় এবার সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখবে তারা। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন কেউ গুজব ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে কাজ করবে পুলিশের সাইবার টিম। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জলকামান, এপিসি (আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার), প্রিজন ভ্যান প্রস্তুত রাখা হবে।
বিএনপির সর্বাত্মক প্রস্তুতি
দীর্ঘ ১২ দিনের টানা বিরতির পর ঘোষিত আজকের গণমিছিলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে দায়িত্ব। কর্মসূচির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষের ঢল নামানোর পরিকল্পনায় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এ কর্মসূচি থেকেই নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপি সূত্র বলছে, রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ব্যর্থতার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আবারও সংগঠিতভাবে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আজকের দুটি গণমিছিলের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। যদিও ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের কাদা ছোড়াছুড়িতে বিব্রত দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। একদিকে কার ওপর সাংগঠনিক শাস্তির খড়্গ ভর করে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা; অন্যদিকে ধারাবাহিক কর্মসূচির চাপ– দুই মিলে অস্বস্তি বিরাজ করছে পুরো দলে। এর মধ্যে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবদলের দায়িত্বশীল নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আতঙ্ক বিরাজ করছে নেতাকর্মীর মধ্যে। সাংগঠনিক ব্যবস্থার পরবর্তী ধাপ কোন দিকে যায়, কাকে টার্গেট করা হয়েছে– এ নিয়ে চলছে জল্পনাকল্পনা। এতে দলের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানা গেছে।
অবশ্য এসব জটিলতা সাময়িক দাবি করে দলের নেতারা জানান, তারা এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রয়েছেন। তারা এখন আগামী দিনের যে কোনো কর্মসূচি সফল করতেই ব্যস্ত সময় পার করছেন। যে কোনো মূল্যে রাজপথেই তাদের দাবি আদায় করতে সব প্রস্তুতি নিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর প্রস্তুতি সভা করেছেন, মতবিনিময় করেছেন সংগঠনের নেতারা। আগামীতে যে কোনো আন্দোলনে সবার আগে থাকার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম সমকালকে বলেছেন, কর্মসূচি সফল করতে তারা সব প্রস্তুতি নিয়েছেন। শুধু নেতাকর্মী নয়, তাদের গণমিছিলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ঢল নামবে।
এদিন বিএনপি ছাড়াও সমমনা অন্যান্য জোট ও দল একই কর্মসূচি পালন করবে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত; ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের সামনে থেকে বিকেল ৪টায়; এলডিপির উদ্যোগে কারওয়ান বাজার এফডিসিসংলগ্ন এলডিপি অফিস সামনে থেকে বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত; গণফোরাম ও পিপলস পার্টি মতিঝিল নটর ডেম কলেজের উল্টো দিকে গণফোরাম চত্বরের সামনে থেকে বেলা ৩টা থেকে শুরু হয়ে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত; গণঅধিকার পরিষদ (নুর) উদ্যোগে পুরানা পল্টন গণঅধিকার পরিষদ অফিসের সামনে থেকে বেলা ৩টায় বিক্ষোভ সমাবেশ; গণঅধিকার পরিষদ (রেজা) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে বেলা ৩টায় গণমিছিল শুরু হবে। এ ছাড়া এনডিএমের উদ্যোগে মালিবাগ মোড় থেকে সন্ধ্যা ৭টায় গণমিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
রাজপথ ছাড়বে না আওয়ামী লীগ
এদিকে বরাবরের মতো শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি না থাকলেও আজও রাজপথ নিজেদের দখলে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। সতর্ক অবস্থানের কর্মসূচি গোটা রাজধানীতেই পালনের জন্য দলের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিজ নিজ দলীয় কার্যালয়ের সামনে সকাল থেকে বিএনপি ও তার মিত্রদের গণমিছিলের কর্মসূচি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থান ধরে রাখতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার দলের পাশাপাশি অন্য সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীকেও এই সতর্ক অবস্থানে সম্পৃক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য আজকের সতর্ক অবস্থানের প্রস্তুতির প্রশ্নে তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি নেতাকর্মীর মধ্যে। এ প্রসঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর নেতারা বলছেন, বিএনপি ও তার মিত্রদের কর্মসূচিকে ঘিরে সম্ভাব্য নৈরাজ্য ও সংঘাত ঠেকাতে এই সতর্ক অবস্থানের কর্মসূচি আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন তারা। এমনকি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকবেন– এটা তো তাদের আগেরই ঘোষণা। সর্বস্তরের নেতাকর্মী আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রয়েছেন। ফলে নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ারও কিছু নেই। তার পরও বৃহস্পতিবারই সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট নেতাদের কাছে বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের গণমিছিলকে ঘিরে কোনো ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা দেখামাত্রই তা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ১৪ দলের ব্যানারে আজকের শান্তি সমাবেশের মাধ্যমে রাজপথ দখলে রাখার প্রচেষ্টা থাকবে সরকার সমর্থকদের। যদিও এই কর্মসূচিটি ১৪ দলের আগে ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে জানিয়েছেন জোট নেতারা। তারা বলছেন, আগেই ১৪ দলের সিদ্ধান্তে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শান্তি সমাবেশ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা। রাজধানীর একেক এলাকায় একেক দিন হিসেবে মোট সাতটি শান্তি সমাবেশ পালনের কথা রয়েছে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও শাহবাগ এলাকায় শান্তি সমাবেশ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরায় আজকের শান্তি সমাবেশ ডাকা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর এলাকায় এই সমাবেশের আয়োজন থাকায় এই অংশের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীকে সমাবেশে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১৪ দলের অন্য শরিক দলগুলোও সাধ্য মতো নেতাকর্মীর সমাগম ঘটাবেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি সমকালকে বলেছেন, আন্দোলনের নামে বিএনপির সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও দেশবিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আগে থেকেই তো মাঠে রয়েছেন তাঁরা। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে সতর্ক থেকে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবেন নেতাকর্মীরা। কোনো অবস্থায়ই বিএনপি ও তার জোটগুলোকে কোনো সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া হবে না।
প্রস্তুত থাকবে পুলিশ
যে কোনো সহিংস ঘটনা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকবে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, কোনো দলকে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিইনি আমরা। তবে পুলিশ সতর্ক থাকবে। জনগণের জানমাল রক্ষায় থাকবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে এমনিতেই সব সময় যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পাশাপাশি শুক্রবার রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আরও বাড়তি সতর্কতায় থাকবে পুলিশ। সার্বক্ষণিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হবে।