ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

লেখক

তরুণের হাসিঘেরা মুখের রোশনাই

তরুণের হাসিঘেরা মুখের রোশনাই

আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৪১ | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১২:১৬

ফি বছর একুশের বইমেলা আসে, বসন্ত আর বইবসন্ত যেন আরও জাঁকজমক হয়ে ওঠে। আর আমার মনে পড়ে, প্রথম যেবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছিলাম, সেই কথা। আসলে সেদিন বইমেলায় আমি কেন এসেছিলাম? যুদ্ধ করতে? প্রথাগত সাহিত্যের বিরুদ্ধে লড়াই? আদতে আমরা তখন গেরিলাই ছিলাম, সৈয়দ শামসুল হকের ‘গেরিলা’ কবিতার মতোই– ‘নিসর্গে তুমি নতুন বৃক্ষ/ নতুন বর্ষা নতুন ফুল’।

সে সময় আমাদের ছিল ফুল হয়ে ফোটার কাল। প্রকৃতিতে তখন কি বসন্ত ছিল, অথবা হয়তো বসন্ত আসি আসি করছিল চৈত্রের ধুলোমাখা উড়নচণ্ডী হাওয়ায়। তবে আমার মনে বসন্ত যে বেশ জেঁকে বসেছিল– তা হলফ করেই বলা যায়। ফলে আমার মনের ভেতর সেদিন ফরফর ফরফর করছিল মাতাল বাতাস। 

মফস্বলে জন্ম নেওয়া আমি বইমেলা মানে বুঝতাম, আট-দশটা টেবিলে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসা। আমাদের শহরে বইয়ের মেলাগুলো সাধারণত ছিল এমনই। তবে ঢাকা শহরে প্রথম যখন বইমেলা দেখলাম, মনে হলো, এ কী কায়কারবার– বই আর বই, এ তো বই– মানুষে একাকার চারদিক!

‘বই-মানুষ’ শব্দটি ঝোঁকের মাথায় লিখে ফেলেছি। কিন্তু লেখামাত্র মন বলল, যথার্থই লেখা হয়েছে। আমার কাছে একুশের বইমেলা অর্থ হলো বই-মানুষ। এখানে বই আর মানুষ– এই দুই শব্দের মাঝখানের হাইফেনটি মুছে দিয়ে লেখা যেতে পারে ‘বইমানুষ’।

পয়লাবার বন্ধুবান্ধবসমেত এসেছিলাম বইমেলায়, বাংলা একাডেমি চত্বরে। সেটা ২০০০ সালের কথা। ‘কী ভালো আমার লাগল’ অবস্থা তখন। বইমেলা সে সময় বসত কেবল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। আর আমাদের মচ্ছব ছিল লিটল ম্যাগাজিন চত্বর ঘিরে। মেলা উপলক্ষে কত বিচিত্র লিটল ম্যাগাজিন বের হতো তখন! সেগুলো থেকে গোলাবারুদ সংগ্রহ করতাম আমরা। তেজি কোনো লিটল ম্যাগাজিনে লেখা না থাকলে খুব আফসোস হতো।

রংপুর থেকে ‘ক্যাথারসিস’ বের করতেন চিনু কবির, যশোর থেকে ‘প্রতিশিল্প’ নিয়ে আসতেন মারুফুল আলম, শাহ মোহাম্মদ আলম ও কামরুল হুদা পথিকের ‘দ্রষ্টব্য’ প্রকাশিত হতো বগুড়া থেকে, মাহবুব কবিরের ‘অক্ষর’-এর ঠিকানা ছিল নেত্রকোনা।

লিটল ম্যাগাজিনের সুবাদে এই রংপুর, যশোর, বগুড়াসহ আরও অনেক মফস্বল মিলেমিশে যেত বইমেলায়। গোপালগঞ্জ থেকে ‘দূর্বা’ বের করতেন গাজী লতিফ। দিনকয়েক আগে ছোটকাগজ অন্তঃপ্রাণ সেই কবি ও সম্পাদক গাজী লতিফ ভাই মারা গেছেন। মেলায় প্রতিবছর একবার হলেও দেখা হতো তাঁর সঙ্গে। এবার থেকে আর দেখা হবে না। মেলায় এমন অনেকের সঙ্গেই তো আর দেখা হয় না। আবার বিনা নোটিশে ‘নাই’ হয়ে গেছে অনেক লিটল ম্যাগাজিন, এ-ও কি এক ধরনের মৃত্যু? ‘ক্যাথারসিস’ কি বের হয় এখন? চিনু কবির মেলায় আসেন রংপুর থেকে?

বইমেলা এলেই এমন বিস্তর কিছু মনে পড়ে, মনের মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ ঘাই মারে অঢেল স্মৃতি। আগের চেয়ে বইমেলা এখন অনেক বেশি ভরভরন্ত, বাংলা একাডেমি প্রান্ত ছাড়িয়ে তা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত, শানশওকতও বেড়েছে। মানুষের আনাগোনাও নিশ্চয় আগের চেয়ে বেশি। আর বইয়ের স্টল? তা-ও অনেক বাড়বাড়ন্ত।

শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের দিকে তাকালে মনে হয়, সে যেন বড়লোক বাবার গরিব সন্তান– ‘মায়ে তাড়ানো, বাপে খেদানো’। লিটল ম্যাগাজিনের সেই দারুণ যৌবনে কি এখন কিছুটা ভাটার টান জেগেছে? যুগ বদলের হাওয়ায় এসেছে প্রযুক্তির প্রবাহ। লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প হিসেবে তাই নানান রকমের ওয়েব ম্যাগাজিন হয়তো দ্রোহটা জাগিয়ে রাখতে চায়। তবু প্রতিবছর এখনও কিছু লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয়, চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে এবং বুকটান করে তারা দাঁড়িয়ে থাকে মেলায়। বের হয় এন্তার বইও।

বইমেলায় প্রতিদিনই বাড়ে বইয়ের ভিড়। আর ফেব্রুয়ারিজুড়ে আমাদের ফেসবুকও রঙিন হয়ে ওঠে নতুন নতুন বইয়ের প্রচ্ছদে। এই যে এত এত বই, এর ভিড়ে যেটি আমি পড়তে চাই, সেই বই কীভাবে খুঁজে পাই! পত্রপত্রিকা কিছু কিছু বইয়ের খবরাখবর দেয় বটে, নিজেদের পুস্তক নিয়ে লেখকেরা সরব থাকেন ফেসবুকেও। তো সেসব সম্বল করেও পাঠক হিসেবে বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে অনেকটা ‘অন্ধের মতো’ নতুন নতুন বইয়ের পাতা উল্টাই, নতুন কিছু খুঁজি আঁতিপাঁতি করে। কিছু পাই, কিছু-বা পাই না। 

পাওয়া না-পাওয়াকে সঙ্গী করেই বইমেলায় যাই– প্রায় সবাই-ই যান কবি-লেখকের সঙ্গে দেখা হবে বলে, বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে আড্ডার আকাঙ্ক্ষায়। কোনো তরুণ কবির ঔদ্ধত্য দেখতেও বইমেলার মাঠে ঘুরিফিরি আমরা। নতুন বইয়ের মধ্যে একটা ঝাঁজ থাকে, সুগন্ধ থাকে। সেই সুবাস বড়ই মনোরম।

একবার কল্পনা করুন তো, বইমেলায় কোনো এক তরুণ কবি বা লেখকের প্রথম বই এসেছে। বারবার তিনি দেখছেন নিজের বইটি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছেন সদ্য বাঁধাই হয়ে আসা তাঁর বইটির আত্মাকে, এমনকি পরিচিতজনদের দেখাচ্ছেনও। সেই তরুণের হাসিঘেরা মুখের রোশনাইয়ে ক্ষণে ক্ষণে মেলা প্রাঙ্গণ কি আরেকটু উজালা হয়ে উঠছে? সেই লেখিয়ের চোখের উজ্জ্বলতা এমন, যেন এইমাত্র সকালের সূর্য এসে ভর করেছে তাঁর দৃষ্টিতে–এই দৃশ্য খুবই পবিত্র না? 

হ্যাঁ, এই সব দৃশ্য দেখতেই আমি বইমেলায় যাই, এসব দৃশ্য দেখার জন্যই যানজট উজিয়ে প্রতিদিন মেলার ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে এত ভালো লাগে!

লেখক: কবি

আরও পড়ুন

×