ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সাহিত্যে নোবেল

অন্তর্ভেদী আখ্যানে হান কাংয়ের বিশ্বজয়

অন্তর্ভেদী আখ্যানে হান কাংয়ের বিশ্বজয়

হান কাং

 আশিক মুস্তাফা

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৫৭ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪ | ১০:১৯

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান কবি ও কথাশিল্পী হান কাং। গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় সুইডেনের স্টকহোমে অবস্থিত সুইডিশ একাডেমি থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে পুরস্কার দেওয়া হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিজ্ঞানী ও নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে। সুইডেনের রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাভের কাছ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন হান কাং। নোবেলজয়ী হান কাং পাবেন ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার (১০ লাখ ডলার), যা বাংলাদেশি ১২ কোটি টাকা সমমানের। গত বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন নরওয়ের লেখক ও নাট্যকার ইয়োন ফসে।

হান কাং ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন, ৯ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সিউলে পাড়ি জমান। সাহিত্যিক পরিবারের পটভূমি থেকেই মূলত তিনি লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর বাবা ঔপন্যাসিক হান সিউং য়ুন। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি চিত্রকলা এবং সংগীতেও ছিলেন পারদর্শী; যা কথাশিল্পী হান কাংয়ের সমগ্র সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। ৫৩ বছর বয়সী হান কাংয়ের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৯৩ সালে, স্থানীয় ‘লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’ সাময়িকীতে গুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৫ সালে ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গদ্যও পাঠকের সামনে আসে। পরবর্তী সময়ে একের পর এক উপন্যাস ও ছোটগল্প প্রকাশ করেন হান। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’। যা প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। হান কাংয়ের যেসব বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে, এটি সেগুলোর প্রথম দিকেরই একটি। এই উপন্যাসের জন্য হান কাং ২০১৬ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান। ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’-এ তিনি মানুষের নিষ্ঠুরতা নিয়ে আতঙ্কে ভুগতে থাকা এক তরুণীর ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার চেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এ পুরস্কারের জন্য হান কাংকে মনোনীত করার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটির সভাপতি অ্যান্ডারস অলসন বলেন, ‘হান কাং তাঁর অন্তর্ভেদী কাব্যিক গদ্যে ঐতিহাসিক যন্ত্রণাদায়ক বিষয়াবলিকে রূপায়ণ করেছেন মুনশিয়ানার মাধ্যমে। সেই সঙ্গে মানবজীবনের ভঙ্গুরতার ছাপও দেখা যায় তাঁর সাহিত্যে।’

হান কাংয়ের উল্লেখযোগ্য আরেকটি উপন্যাস ‘ইউর কোল্ড হ্যান্ডস’। ২০০২ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আর তিন পর্বে লেখা উপন্যাস ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’-এর প্রধান চরিত্র ইয়ং-হাই যখন খাদ্যাভ্যাসের সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন এর সহিংস পরিণতি কী হয় তা পড়ে আঁতকে ওঠেন পাঠক! হানের লেখায় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা গভীরভাবে ফুটে ওঠে; যা প্রাচ্য দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত।  দেহ-আত্মা, জীবিত ও মৃতের মধ্যকার সম্পর্ককে এখানে অনন্যভাবে তুলে ধরা হয়। তাঁর কাব্যময় ও পরীক্ষামূলক লেখার শৈলীতে তিনি আধুনিক গদ্যের একজন উদ্ভাবক হিসেবেও বিশেষ পরিচিতি পান। 

তাঁর প্লট-ভিত্তিক উপন্যাস হলো– ‘দ্য ওয়াইন্ড ব্লোস, গো’। ২০১০ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে দেখা যায় বন্ধুত্ব ও শৈল্পিকতার জটিল সমীকরণ। যেখানে দুঃখ ও রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা যেন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় হানের উপন্যাস ‘গ্রীক পাঠ’। বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে । এতে দু’জন দুর্বল মানুষের সম্পর্কের গভীরতার মনোমুগ্ধকর চিত্রায়ণ করেছেন হান। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে বাকশক্তি হারানোর পথে থাকা এক যুবতী তাঁর প্রাচীন গ্রিক ভাষার শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান, যিনি নিজেই ক্রমে হারাচ্ছিলেন দৃষ্টিশক্তি। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যসমগ্র, ছোট গল্প সংকলন, উপন্যাসিকা ও উপন্যাস। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– ‘ডোন্ট সে গুডবাই’, ‘হোয়াইট’, ‘অ্যা বয় ইস কামিং’, কাব্যগ্রন্থ ‘আই পুট ডিনার ইন দ্যা ড্রয়ার’, ‘ইয়োলো প্যটার্ন এটার্নিটি’, ‘গ্রিক টাইম’, ‘দ্য ওয়াইন্ড ব্লোস, গো’, ‘টিয়ার বক্স’, ‘থান্ডার লিটল ফেইরি, লাইটিং লিটল ফেইরি’, ‘লাভ অ্যান্ড থিংস সারাউন্ডিং লাভ’, ‘দ্য রেড ফ্লাওয়ার স্টোরি’, ‘মাই নেম ইজ সানফ্লাওয়ার’, ‘ইউর কোল্ড হ্যান্ডস’ এবং ‘মাই ফ্লাওয়ারস ফ্রুটস’ ইত্যাদি।  

সুইডিশ একাডেমিকে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের পুরস্কারের তালিকায় পুরুষ লেখকদের আধিক্যের জন্য। মাত্র ১৭ জন নারী এই সম্মান পেয়েছেন। ২০১৮ সালের #মিটু কেলেঙ্কারির পর থেকে সুইডিশ একাডেমি বড় ধরনের সংস্কার এনেছে এবং বিশ্বব্যাপী  লিঙ্গসমতার ভিত্তিতে সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে সময় থেকে একাডেমি চারজন নারীকে সম্মানিত করেছে; এরই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হন হান কাং! অন্য তিনজন হলেন– ফ্রান্সের অ্যানি আর্নো, মার্কিন কবি লুইস গ্লুক ও পোল্যান্ডের ওলগা তোকারচুক। 

নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে প্রতিবছর চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবতার কল্যাণে যারা অবদান রাখেন, তারা পান বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার। ১৯০১ সালে ফরাসি কবি ও গদ্যকার সুলি প্রুদোমকে পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন করা হয়েছিল। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের ভেতর সমসাময়িক যারা, তারা হলেন– ইয়োন ফসে, আনি আরনো, লুইস গ্লিক, ওলগা তোকারচুক, কাজুও ইশিগুরো, সভেৎলানা আলেক্সেইভিচ, এলিস মুনরো, মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা, ওরহান পামুক প্রমুখ।

মানুষের হৃদয়জয়ী প্রয়াত নোবেলজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জর্জ বার্নার্ডশ, টমাস মান, রমা রলাঁ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন স্টেইনবেক, পাবলো নেরুদা, নাদিন গর্ডিমার, অক্টাভিও পাজ, নাগিব মাহফুজ, ইউসুনারি কাওয়াবাতা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হোসে সারামাগো প্রমুখ। এ পর্যন্ত সাহিত্যে সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রুডইয়ার্ড কিপলিং; ৪১ বছর বয়সে। সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ডোরিস লেসিং; ৮৮ বছর বয়সে।

আরও পড়ুন

×