সাক্ষাৎকার
উন্নতি করতে হলে সব সময় টাকার দিকে ঝুঁকতে পারবেন না

সেকান্দার আলী
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৩:৫৬
দেশে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার কম। লিটন কুমার দাসদের তাই টানা জাতীয় দলের সিরিজ খেলতে হয়। সুযোগ পেলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ বা কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে যেতে পারেন না তাঁরা। ফলে উন্নতির জায়গাটা সীমিত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন লিটন। বিপিএলেও তারকা ক্রিকেটার আগের মতো খেলছে না বলে দাবি তাঁর। উইকেটরক্ষক এ ব্যাটার জানান, আন্তর্জাতিক বোলারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করতে পারলে খেলোয়াড়দের সাহস বাড়ে। লিটন কুমার দাসের সঙ্গে একান্তে কথা বলে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, বিদেশি বড় দলগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ জেনেছেন সেকান্দার আলী। লিটনের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব আজ
সমকাল: ২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে। সেই বাংলাদেশ দলই কেন টি২০-তে এখন পেছনের সারিতে?
লিটন: আমি যেটা ফিল করি, অনেকে বলেন আমরা ওয়ানডেতে ভালো দল। আসলে কতগুলো সিরিজ আমরা বিদেশে গিয়ে জিতেছি? আপনি যখন বড় কোনো স্বপ্ন দেখবেন তখন হোম এবং অ্যাওয়ে দুটোতেই জিততে হবে। হোমে জিতবেন, অ্যাওয়েতে জিতবেন না তাহলে হবে না। হ্যাঁ, আমরা ভালো ক্রিকেট খেলিনি তা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকাতে একটা সিরিজ জিতেছি। আমার যে পয়েন্ট, আমরা তখনই ভালো দল হব যখন বিদেশে গিয়ে সেই দেশের দলকে হারাতে শুরু করব। আমরা নিউজিল্যান্ডে জিততে পারিনি। আমরা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াতে খুব কমই যাই। ওই দেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে তো খেলিই না। তাদের দুর্বলতা বা সবলতা জানব কি করে? তাই বড় বড় ইভেন্টে গিয়ে এরকম দলকে মোকাবিলা করতে গেলে ব্যাটার বা বোলার নার্ভ ধরে রাখতে পারে না। কথার কথা আফগানিস্তান ম্যাচের কথাই যদি চিন্তা করি- মুজিব, রশিদ, ফারুকী খুব ভালো কোয়ালিটিসম্পন্ন বোলার। এই বোলারদের নিয়মিত না খেললে শুধু ভিডিও দেখে বড় ইভেন্টে গিয়ে মোকাবিলা করা সহজ নয়। বাস্তব খেলার অভিজ্ঞতা থাকবে হবে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের দলের এই জিনিসগুলোতে দুর্বলতা আছে। আমরা এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপে গিয়ে বড় বড় বোলারকে খেলি। আমি ছয় বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে মিচেল স্টার্ককে মোকাবিলা করেছি মাত্র দুবার। ১৯ বিশ্বকাপে, আর ২০২১ সালের টি২০ বিশ্বকাপে। একজন বোলারকে টিভিতে দেখে বিচার করতে পারবেন না, যতক্ষণ নিজে মোকাবিলা করছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি বোলার আমার কাছে এখন অপরিচিত। কারণ আমি খেলিইনি। প্যাট কামিন্স এবং জাম্পার দু'একটা বল খেলেছি। এখন হ্যাজেলউড বল করলে আমার কাছে অপরিচিত মনে হবে। একজন ব্যাটার তখনই ভালো করে, যখন নিয়মিত একজন বোলারকে খেলতে থাকবে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের এখানটায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে- আমরা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলিই না। দ্বিতীয়ত প্রতিটি দল ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অ্যাওয়ে সিরিজ খেলে। আমরা কেন খেলি না? ৭ বছরে আমি কোনো সিরিজ খেলার সুযোগ পাইনি ওদের ওখানে। আমরা টিভিতে দেখি তারা নেমেই মারে বা উইকেট পায়। নিজে যখন ব্যাটিং বা বোলিং করবেন তখন মাথায় থাকবে আমি বল করলেই মেরে দেবে। ব্যাটিংয়ে গেলে আউট করে দেবে। আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেটারদের এই জিনিসগুলো একটু হলেও নেতিবাচক চিন্তা করতে বাধ্য করে। আমরা যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে বেশি খেলার সুযোগ পাই তাহলে বিদেশের বড় বড় বোলারদের মোকাবিলা করার সুযোগ পাব।
সমকাল: বিপিএলে তো বিদেশি তারকা বোলার খেলেন-
লিটন: বিপিএল শুরুর পর থেকে আমরা ভালো করতে শুরু করেছি। রাসেল, পোলার্ড, ক্রিস গেইল, শেন ওয়াটসন খেলে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে খেলে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। বিশ্বে যারা বড় ক্রিকেটার তারা ড্রেসিংরুমে এলে তরুণদের ভেতরে নার্ভ কাজ করবে। একটা মাস যখন ড্রেসিংরুম শেয়ার করবে, এরপর যখন খেলতে যাবে তখন মনে হবে এই খেলোয়াড়কে তো আমি চিনি। খেলাটা তখন সহজ হয়ে যাবে। আমার কাছে মনে হয় এটা বড় ফ্যাক্ট। আমরা যত বেশি বিদেশে ক্রিকেট খেলব, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলব তত বেশি মেন্টাল ব্যারিয়ার কেটে যাবে। বাংলাদেশে একটাই অপশন, বিপিএল দিয়ে বিদেশি ক্রিকেটার আনতে পারবেন। ঢাকা লিগে আমরা পাই শ্রীলঙ্কা, ভারত বা পাকিস্তানের মোটামুটি মানের খেলোয়াড়। গত বছর আমি বিপিএলে ফাফ ডু প্লেসিসের সঙ্গে খেলেছি। তাঁকে আমি সারাজীবন টিভিতে দেখেছি বা প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছি। যখন একই দলে খেললাম তখন বুঝতে পারলাম তাঁর চিন্তাভাবনা কি। সে আমাকে কিছু টিপস দিয়েছে। এই যে ছোট ছোট টিপসগুলো এটাই একজন খেলোয়াড়কে সাহায্য করে। এটা আমরা পাই বিপিএল থেকে। আমরা বিপিএলকে যদি আগের মতো আপগ্রেড ভার্ষণে ফিরিয়ে নিতে পারি তাহলে লাভ হবে। পাশাপাশি দেশের বাইরের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে খেলা দরকার।
সমকাল: বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা কেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সুযোগ পান না?
লিটন: ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলো নিতে চায় না এটা ভুল কথা। আমিও দু'একবার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথমবার সিপিএলে খেলে আসার পর দ্বিতীয়বার ডেকেছিল। কিন্তু আমার সুযোগ ছিল না খেলার। কারণ আমাদের জাতীয় দলের দায়িত্ব অনেক বেশি থাকে। জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে আমরা খেলতে পারি না। এটা যেমন একটি কারণ তেমনি অন্য বোর্ডগুলো ক্রিকেটারদের ছেড়ে দেয় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার জন্য। আমাদের খেলোয়াড় কম হওয়ায় সেটা সম্ভব হয় না। ইচ্ছে থাকলেও বোর্ড খেলোয়াড় ছাড়তে পারে না। জাতীয় দল এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ একই সময় এলে জাতীয় দলকেই বেছে নেবে সবাই। আবার গ্যাপে খেলার সুযোগ পেলেও সামনের সিরিজের জন্য ক্রিকেটারদের ফিট রাখতে বোর্ড ছাড়তে চায় না। কারণ একজন ইনজুর্ড হয়ে গেলে বিকল্প নেই। বিদেশে সেটা আছে। ভারত তিনটা জাতীয় দল করতে পারবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের অনেক খেলোয়াড় আছে। আমরা সংখ্যায় অনেক কম, তাই হয়তো বোর্ড ঝুঁকি নিতে পারে না। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে পারলে এক মৌসুমেই অনেক ক্রিকেটারের সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। যেটা ৩-৪টি আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেও হয় না।
সমকাল: কাউন্টি ক্রিকেট বা টি২০ ব্লাস্টে খেলার সুযোগ নেওয়া যেতে পারে? যদিও সম্মানী খুব কম দেয়।
লিটন: নিজের ক্রিকেটের উন্নতি করতে হলে সব সময় টাকার দিকে ঝুঁকতে পারবেন না। কিছু কিছু সময় ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ৫-১০ লাখ টাকায় খেলতে হবে। কাউন্টিতে ৩-৪ মাস খেলে আসতে পারলে অনেক কিছু শেখা হয়ে যাবে। এখন কথা হচ্ছে বিদেশি লিগে খেললে ডিপিএলে খেলতে পারবেন না। জাতীয় দলের প্রচুর খেলা মিস করতে হবে। এসব কারণেই আমাদের খেলোয়াড়রা বিদেশের লিগে যেতে পারেন না। তবে জাতীয় দলে না থাকলে এই সুযোগগুলো নেওয়া উচিত। জাতীয় লিগে না খেলে কাউন্টি বা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ পেলে যাওয়া উচিত। কারণ ওখানে আন্তর্জাতিক বোলার বা ব্যাটারদের খেলার সুযোগ পাবেন স্পোর্টিং উইকেটে। তাতে ওই খেলোয়াড়ের ক্রিকেটের উন্নতি হবে। বাংলাদেশ দলও ভালো কিছু পাবে।
- বিষয় :
- লিটন দাস
- সাক্ষাৎকার
- খেলা-ক্রিকেট-বাংলাদেশ