আবার সাকিব অধ্যায় শুরুর অপেক্ষা

সাকিব আল হাসান
সঞ্জয় সাহা পিয়াল
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৩ | ০২:৪৩
পক্ষে ‘থাকা’ আর ‘না থাকা’ নিয়ে মাঝের লড়াইয়ে সমর্থকের বড় একটি অংশের এতটা শক্তি ক্ষয় হয়েছে যে তারা এখন বড্ড ক্লান্ত! শেষ পর্যন্ত তামিম ইকবালের ওয়ানডে নেতৃত্ব ছাড়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেটাঙ্গন যেন ভীষণভাবে শান্ত। কিন্তু এমন নিস্তরঙ্গ জীবন আর ক’দিন চলে? যুগ যখন সোশ্যাল মিডিয়ার, ভালোবাসা ও ক্রোধ– সবটাই যেখানে অপরিমেয়, সেখানে নতুন বিষয় না হলে ফেসবুকের কাঠগড়ায় শত্রুনাম না থাকলে যে দম বন্ধ হয়ে যাবে সমর্থককুলের। তাই ক্রিকেটের নতুন বিষয়– বিশ্বকাপের অধিনায়ক হবেন কে?
সাকিব আল হাসান, লিটন কুমার দাস, নাকি অন্য কেউ? এখানেও পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আবেগের স্রোত বইবে নিশ্চিত। এবং বিসিবিও সেই আবেগের ভরা পুকুরে ঘটি ডুবিয়ে জল মাপার চেষ্টা করবে, বোঝার চেষ্টা করবে কোন দিকের পাল্লা ভারী। বিসিবিপ্রধান নাজমুল হাসান পাপন সে ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন, ‘দু-চার দিনের মধ্যে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব, কে হবেন ওয়ানডের পরবর্তী অধিনায়ক।’ অভিজ্ঞতা, পারফরম্যান্স আর ড্রেসিংরুমের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতায় নিঃসন্দেহে এগিয়ে সাকিব আল হাসান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাকিব কি তামিমের খুলে রাখা আর্মব্যান্ড নিতে রাজি হবেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে ২ আগস্ট সমকাল নিশ্চিত হয়েছিল, তিনি ওয়ানডে নেতৃত্ব নিতে আগ্রহী নন। কিন্তু সেটা ছিল তামিমের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার আগের সময়টাতে। মাঝে কয়েক দিন পার হয়েছে। এর মধ্যে সাকিব কি তাঁর মত পরবর্তন করবেন, নাকি তাঁর সমর্থনেই লিটন দাসকে এশিয়া কাপ থেকে অধিনায়ক করা হবে– সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে সাকিবের ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, বিসিবি থেকে দীর্ঘ মেয়াদের প্রস্তাব পেলে তা ইতিবাচকভাবেই দেখবেন তিনি। হয়তো দু’পক্ষের মধ্যে কিছু ব্যাপার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চলবে, শেষ পর্যন্ত হয়তো সাকিব রাজি হবেন। এবং সাকিবের ওপর ভর করেই পরবর্তী অধ্যায়ে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
আর এ অনিশ্চয়তার মধ্যেই আপাতত আন্দোলিত বাংলাদেশ ক্রিকেট। ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করেছিলেন সাকিব আল হাসান। তাই তাঁর কাছে ব্যাপারটি নতুন নয়। তখনকার বছর চব্বিশের সাকিব এখন অনেক বেশি পরিণত। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ভারতের যেসব মাঠে বিশ্বকাপের খেলা হবে, তার সবগুলোতেই খেলেছেন সাকিব। সেখানকার কন্ডিশনও তাঁর চেনা। তা ছাড়া সাকিবের একটি বিশেষ গুণ নিয়ে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও বেশ ভরসা পান। তা হলো প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের নিয়ে সাকিবের বিশেষ ধরনের স্টাডি। ব্যাটিং ও বোলিং– অলরাউন্ডার হওয়ায় কিছু না কিছু দিয়ে ম্যাচে নিজের প্রভাব ফেলতে পারেন সাকিব। ড্রেসিংরুমেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাই তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে পাওয়া গেলে টিম ম্যানেজমেন্টের স্বস্তি বাড়বে। কিন্তু সাকিবের নিজস্ব মতামতই এখানে গুরুত্ব পাবে বেশি। এমনিতে এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। গত বিশ্বকাপে অধিনায়ক না থেকেও দলের সেরা পারফরমার ছিলেন তিনি। সেবার ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে মাশরাফি অধিনায়ক থাকলেও মাঠে দলের বড় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন সাকিব। তাই অধিনায়ক না থেকেও যে সাকিবের সক্রিয় উপস্থিতি থাকে, সেটা নিয়ে সংশয় নেই। এখানে একটি ব্যাপারে সময় নিচ্ছে বিসিবি– নতুন অধিনায়ককে কি বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে, নাকি লম্বা সময়ের জন্য। সাকিবকে যদি অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার বিসিবির বিবেচনাধীন, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রে সাকিবের পরিবার থাকে, সেখানেও তাঁকে সময় দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে নতুন কাউকে অধিনায়কত্ব দেওয়া যেতে পারে। সেই আলোচনাতেই লিটনের নাম এসে যায়। তামিমের অনুপস্থিতিতে ঘরের মাঠে ভারত ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি সিরিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন লিটন। তা ছাড়া টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে এটা ওপেন সিক্রেট যে লিটন হচ্ছেন দলের মধ্যে সাকিবের ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট! সাকিবের ছায়াতেই নেতৃত্ব সমৃদ্ধ করছেন লিটন। তিনি অধিনায়ক হলে তাতে সাকিবেরই উপস্থিতি থাকবে। তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামে তামিমের অনুপস্থিতি নিয়ে লিটনের বলা একটি মন্তব্য ঘিরে বিসিবিতে নেতিবাচক আলোচনা রয়েছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, সাকিবের হাত থেকেই অধিনায়কত্ব গিয়েছিল তামিম ইকবালের হাতে। আইসিসি থেকে নিষেধাজ্ঞার পর অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১৯ সালের নভেম্বরে তামিম ইকবালের হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল বিসিবি। তামিমও জানতেন তা, তাই একেবারে পরিকল্পনা করে ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়নি। নেহাত অন্তর্বর্তীকালের জন্য দল চালানোর দায়িত্ব তাঁর। সেটাকেও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। চেষ্টা করেছিলেন, বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আইসিসি সুপার লিগে সর্বোচ্চ দিয়ে দল পরিচালনার। এবং তাতে যে তামিম সফল, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু সমস্যাটা বাধে গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় টি২০ বিশ্বকাপের মাঝে। যেখানে গুঞ্জন ছড়ায় অ্যাডিলেডে একটি ম্যাচের পর বিসিবির এক কর্মকর্তা সাকিবের কাছে ওয়ানডে নেতৃত্ব নিয়ে একটি আনঅফিসিয়াল প্রস্তাব দেন। টি২০ থেকে অবসর নেওয়ায় ওই সফরে ছিলেন না তামিম। কিন্তু কথাটি কানে এলে তাঁর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। এমনিতে দেড় বছর ধরে প্রত্যাশিত পারফর্ম করতে পারছিলেন না তামিম, তার ওপর মনের মধ্যে অধিনায়কত্ব নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। সব মিলিয়ে তখন থেকেই অসম্মানিত বোধ করতে থাকেন তামিম। এর প্রভাব পড়ে ড্রেসিংরুমেও। দলের সদস্যরা কেউ বিদেশ সফরে গিয়ে সাকিবের সঙ্গে ডিনার করলেও তা সন্দেহের চোখে দেখা হতে থাকে। সাকিব যেহেতু টেস্ট ও টি২০ অধিনায়ক, সেহেতু তাঁর সঙ্গে এমনিতেই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের যোগাযোগ বেশি। সেই সম্পর্কটাও প্রটোকলের বাইরে গিয়ে করা হয়েছে বলে অনুযোগ ওঠে, যা নিয়ে ড্রেসিরুমেও অস্বস্তি তৈরি হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় তামিমের ফিটনেস ইস্যু। তামিমের মেরুদণ্ডে যে সমস্যা রয়েছে, তা নাকি ‘নাটক’ বলে মনে করত টিম ম্যানেজমেন্টের একাংশ। এসব কিছু মিলিয়েই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত তামিম আফগানিস্তান সিরিজের মাঝে অবসরের ঘোষণা দেন। এসব ঘটনা অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা। আসলে কী হয়েছিল গত কয়েক মাসে, তা হয়তো জানা যাবে ভবিষ্যতে তামিম যদি হাত খুলে আত্মজীবনী লেখেন। তবে আপাতত তামিম ইস্যুতে ইতি টেনেছে বিসিবি। তিনি ফিট থাকলে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড সিরিজ খেলবেন এবং পরে বিশ্বকাপ।
- বিষয় :
- সাকিব