ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার

‘ফেল আম্পায়ার’ এলিট প্যানেলে 

‘ফেল আম্পায়ার’ এলিট প্যানেলে 

শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত

সেকান্দার আলী

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ১০:৫২ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ১২:০৩

খেলা ছেড়ে ২০০১ সালে আম্পায়ারিং শুরু করেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত তৃতীয় বিভাগ বাছাই টুর্নামেন্ট দিয়ে। তিনিই কিনা এখন দেশের একমাত্র এবং প্রথম আইসিসির এলিট আম্পায়ার। প্রান্তিক পর্যায় থেকে আম্পায়ারিং শুরু করা সৈকত প্রথম শ্রেণির ম্যাচ পরিচালনা করেন ২০০৭ সালে। ২০১০ সালে হন আন্তর্জাতিক আম্পায়ার। শেকড় থেকে শিখরে পৌঁছাতে না বলা অনেক গল্পই শোনান সৈকত। তেমনি একটি ঘটনা আম্পায়ারিং পরীক্ষায় পাস করতে না দেওয়া। শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদের ক্যারিয়ার বৃত্তান্ত শুনেছেন সেকান্দার আলী।

সমকাল: অভিনন্দন দেশের প্রথম এলিট আম্পায়ার। 
সৈকত:
আপনার মাধ্যমে দেশের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। 

সমকাল: কবে নিশ্চিত হয়েছিলেন– এলিট আম্পায়ার হচ্ছেন?
সৈকত:
২৫ মার্চ জেনেছি আমাকে এলিট প্যানেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকাশ করা বারণ ছিল তাই বলিনি। তবে খুশি হয়েছি স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন বার্তাটা পাওয়ায়। আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। 

সমকাল: আপনি ভিডিও বার্তায় বলেছেন বিশ্বকাপে ভালোর ফল এটি?
সৈকত:
এটা একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে হয়। একটা টুর্নামেন্ট বা এক-দুইটা টেস্ট সিরিজ দিয়ে মূল্যায়ন করা হয় না। আমি ১৪ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আম্পায়ার। এক বছর ছিলাম ইমার্জিং আম্পায়ার। আন্তর্জাতিক আম্পায়ারের পারফরম্যান্স দিয়ে উন্নীত হয়েছি ইমার্জিং প্যানেলে। আগের পারফরম্যান্সের সঙ্গে যোগ হয়েছে গত এক বছরের পারফরম্যান্স। তবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজের পারফরম্যান্স বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ করার পর বুঝে গেছি আইসিসি আমাকে প্রমোশন দেবে। আসলে বিশ্বকাপ ছিল ‘ওয়ান বুলেট হিট দ্য টার্গেট’।  

সমকাল: এ পর্যায়ে পৌঁছানো কতটা কঠিন ছিল?
সৈকত:
আমি ইমার্জিং দলে সবার পরে এসেছি। তারা আমার আগে দুটি বিশ্বকাপ কাভার করেছে। আর আমার পিঠে খুব একটা আর্শীবাদের হাত কখনোই ছিল না। আমি জানতাম পারফরম্যান্স ছাড়া কোনো গতি নেই। আমি এক জায়গায় ফোকাস রেখেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে থেকেছি। মানুষের কথা শোনা বন্ধ রেখেছি। আমি আমার হৃদয়ের কথা শুনেছি। আমি কথা বলি নিজের তেজ বাড়াতে। এই তেজ আছে বলেই এ পর্যায়ে এসেছি। পারিপার্শ্বিক যাই ঘটেছে, আমি নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরিনি। আমি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলাম। নিরাপদ কন্ডিশনে আম্পায়ারিং করা সহজ কিন্তু বিপরীতে গিয়ে করা খুবই কঠিন। আমি কঠিন কাজটা কঠিনভাবে করেছি। তাই আম্পায়ারিংটা কঠিন লাগেনি। আমি একটা বিশ্বকাপ পেয়েছি, সেটা কাজে লাগিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ পেয়েছি, সেটা কাজে লাগিয়েছি। কারণ আমি জানতাম এই ইভেন্টগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সুযোগ বারবার আসে না। গত ১৪ বছরে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে যে টেস্ট ম্যাচগুলো করেছি সেগুলোর পারফরম্যান্স মূল্যায়ন বেশি হয়েছে। টি২০ ভালো খেললেই ভালো খেলোয়াড় হয় না। তেমনি টি২০ ম্যাচ পরিচালনা করে ভালো আম্পায়ার হওয়া যায় না। টি২০ ও ওয়ানডে দিয়ে একজন আম্পায়ারকে মূল্যায়ন করা সম্ভব না। টেস্ট ম্যাচ দিয়ে সেটা সম্ভব। আমি খুব বেশি সুযোগ পাইনি, তাই জানতাম যেটুকু সুযোগ আসবে, সেটা কাজে লাগাতে হবে। 

সমকাল: কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে?
সৈকত:
ত্যাগ স্বীকার না করলে বড় কোনো অর্জন সম্ভব না। আমি ক্যারিয়ারের প্রথম দিন থেকে আম্পায়ারিং উপভোগ করেছি। সঠিক জায়গায় যৌক্তিক দাবি নিয়ে কথা বলেছি। আমি আমার জায়গা থেকে কখনও সরিনি। বাংলাদেশে আমার থেকে ক্রিকেট চর্চা খুব কম লোকই করে। আমি যেটা জানি, যেটা সঠিক মনে করেছি, সেই জায়গা থেকে কখনও সরিনি। সব সময় হচ্ছে হচ্ছে, হবে না এমন একটা পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু আমি কখনও আশা ছাড়িনি। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে হয়তো আরও আগে এলিট প্যানেল আম্পায়ার হতে পারতাম। দেরিতে হয়েছে তাতেও আমি খুশি। আমার ভিত্তি তৈরি করা ছিল, সেটা পূর্ণতা পেয়েছে। আমার পড়াশোনা এবং ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। প্রশাসনিক কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এগুলো সব কাজে লেগেছে। আম্পায়ারিং শুধু আম্পায়ারিং না, আম্পায়ারিং হচ্ছে স্মার্টনেস ও অ্যাওয়ারনেস। একজন মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হয়, সে তত বেশি সচেতন হয়। আমি আম্পায়ারিং করি না, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাই। পিছিয়ে পড়েছি, ধাক্কা খেয়েছি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। 

সমকাল: বড় মঞ্চে কি কঠিন চ্যালেঞ্জ?
সৈকত:
যত সুযোগ তত চ্যালেঞ্জ, বেশি দায়িত্ব। এত দিন লো প্রোফাইলে ছিলাম, প্রমিজিং হিসেবে দেখা হতো। এখন আমি বিশ্ব ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ে ১২ জনের একজন। যেহেতু আমি যোগ্যতা অর্জন করেছি, এখন আমাকে আরও ভালো কিছু দেখাতে হবে। শুধু মাঠে আউট, নট আউট দিয়ে আম্পায়ারের মূল্যায়ন হয় না। আনুষঙ্গিক অনেক কিছু থাকে। এই জায়গা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। নিজেকে ওইভাবে তৈরি রাখতে হবে। 

সমকাল: আপনার সঙ্গের অনেকের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। আপনার টিকে থাকার রহস্য কী?
সৈকত:
আমি ১৪ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আম্পায়ার। এত বছর টিকে থাকা কঠিন। আমার চোখের সামনে আন্তর্জাতিক প্যানেল থেকে ৫০ জন আন্তর্জাতিক আম্পায়ারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। কেউ অবসরে গেছেন, কেউবা বাদ পড়েছেন। আমি সেই স্বল্প সংখ্যকদের একজন, যে কিনা ১৪ বছর আন্তর্জাতিক এরেনায় টিকে আছি। আমাকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে আম্পায়ারিং করে এলিট আম্পায়ার হতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। দেশের বাস্তবতার কারণ এবং আরও কিছু অনুষঙ্গের জন্য এটা হয়েছে। আমি জানতাম এটা হবেই। আরও পাঁচ থেকে সাত বছর আগে জানতাম এটা হবে। 

সমকাল: ফেসবুকে ‘টুয়েলভ ফেল’ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন– আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে?
সৈকত:
আছে। আমি খেলা ছেড়ে আম্পায়ার হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছি, কিন্তু ছয়লাভ হোসেন টুটুল সাহেবের কমিটি আমাকে পাস করায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার আম্পায়ারিংয়ের লিখিত পরীক্ষায় ফেল করব, তা কি করে হয়। আমি চ্যালেঞ্জ করার পর জাহিদ চৌধুরী ভাই জানান, পাস করেছি। যেদিন জানলাম এলিট আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির প্যানেলভুক্ত হয়েছি। সেদিন ফেসবুকে লিখলাম টুয়েলভ ফেল। অর্থাৎ সেদিনের ‘ফেল করা’ আম্পায়ার আজ আইসিসির এলিট প্যানেলে। 

সমকাল: আপনি তো এখন বিদেশে নিরপেক্ষ ম্যাচে আম্পায়ারিং করবেন। দেশের ক্রিকেট সময় দিতে পারবেন?
সৈকত:
বোর্ড ম্যাচ দিলে অবশ্যই করব। এলিট আম্পায়াররা দেশের ম্যাচ করে। আমি অবশ্যই আমার দেশের ম্যাচ করব। তবে একটা জিনিস হলো আমি এলিট আম্পায়ার হওয়াতে আরেকজন আন্তর্জাতিক প্যানেলে ঢুকতে পারবে। আর আমি যে সুযোগগুলো পেতাম, সেগুলো এখন মুকুল (মাসুদুর রহমান), গাজী সোহেলরা পাবে। 

সমকাল: আম্পায়ারিং করতে গিয়ে কখনও মনে হয়েছে বিপদে আছেন?
সৈকত:
২০১২ সালে স্টিং অপারেশনের পর ছয় আম্পায়ার নিষেধাজ্ঞায় পড়েন। তখন আইসিসির নির্দেশে আমাকেও ম্যাচ দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের নাদিম ঘোড়ি, বাংলাদেশের নাদির শাহ, শ্রীলঙ্কার চারজন আম্পায়ার নিষিদ্ধ হন। একমাত্র আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। তদন্ত চলাকালীন নিষেধাজ্ঞায় ছিলাম। ছয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, বিপিএলেও রাখা হয়নি। ২০১৩ সালের মার্চে গিয়ে মুক্তি পাই। সৎ ছিলাম বলে সমস্যা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার সময় খারাপ লেগেছে।  

আরও পড়ুন

×