সাক্ষাৎকারে মনন রেজা নীড়
‘জিএমদের বেতন দেওয়া উচিত’

ছবি- সংগৃহীত
সাখাওয়াত হোসেন জয়
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ১০:৪৬ | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:০৮
স্কুলের পাট চুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলে ফুটবল খেলা। বাসায় ফিরে দেখেন বাবা নাজিম রেজা কম্পিউটারে দাবার গেম খেলছেন। ছোট্ট বয়সে থাকা মনন রেজা নীড় বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে দেখেন দাবার বোর্ড লাগানো। কৌতূহলবশত বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, কম্পিউটারের খেলা এখানে এলো কীভাবে? এর পর নীড়কে দাবার বোর্ড কিনে দেন তাঁর বাবা। সেই থেকে শুরু। মা মৌমন রেজার পরিশ্রমে নীড় এখন বাংলাদেশের পঞ্চম আন্তর্জাতিক মাস্টার। নারায়ণগঞ্জ থেকে মায়ের হাত ধরে ঢাকাতে এসে দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মনন রেজা নীড় রোববার হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট থেকে হোয়াটসঅ্যাপে নিজের স্বপ্নের কথা বলেছেন সমকালের কাছে। তা শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়
সমকাল : আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
মনন : আইএম হওয়াতে একদিকে ভালো লাগছে, অন্যদিকে খুবই হতাশ। গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মটা পেলাম না বলে খারাপ লাগছে। বলতে গেলে ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছে আমার মধ্যে। হাঙ্গেরিতে আমার আসার উদ্দেশ্যই ছিল জিএম নর্ম পাওয়া।
সমকাল : হাঙ্গেরিতে জিএম নর্ম পাওয়ার আর কোনো সুযোগ আছে?
মনন : হ্যাঁ, একটা প্রতিযোগিতা চলছে। ৭ পয়েন্ট পেলেই গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম হবে। এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। রাউন্ড বাই রাউন্ড বাকি আছে। আমি চেষ্টা করব, যেন দেশে একটা জিএম নর্ম নিয়ে যেতে পারি। তাহলেই এখানে আসা স্বার্থক হবে।
সমকাল : দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব পেলেন।
মনন : এটাকে আমি তেমন কিছু মনে করি না। কারণ বাংলাদেশে সেরা হওয়া আমার লক্ষ্য নয়। এমনকি গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়াও কিন্তু আমার লক্ষ্য নয়। আমি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। সবাইকে এটা বলে আসছি। কী রেকর্ড ভেঙেছি, না ভেঙেছি; এগুলো নিয়ে চিন্তা করি না।
সমকাল : দাবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে তো অনেক ধাপ পার হতে হয়। পৃষ্ঠপোষকতারও প্রয়োজন।
মনন : ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হতে হলে অনেক সহযোগিতা লাগবে। আর্থিক সমস্যার কারণে আমার হাঙ্গেরিতেও আসার কথা ছিল না। তিনটি টুর্নামেন্ট খেলার জন্য অনেক বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন। মডেল গ্রুপের মাসুদ আঙ্কেল ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আমাকে স্পন্সর করেছেন বলেই এখানে আসতে পেরেছি। তাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
সমকাল : সে ক্ষেত্রে ফেডারেশনের কিছু করার ছিল কিনা?
মনন : ফেডারেশনের সহযোগিতা আমরা কেউই পাই না। এই টুর্নামেন্টে তো নাই। অন্য সময়েও ওই রকম পাই না। আমরা যখন কোনো প্রতিযোগিতায় ভালো করি, এর কৃতিত্বটা কিন্তু তারা (ফেডারেশন কর্তারা) নিয়ে নেন। আমরা নিজেরাও জানি না, ফেডারেশন থেকে কেন সহযোগিতা পাচ্ছি না। সব সময় একটা জিনিসই শোনা যায়, বাজেট নেই। তাদের কথা শুনে মনে হয়, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কেন এটা হচ্ছে, তার উত্তর কারও কাছে নেই।
সমকাল : এর জন্য ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের উদাসীনতা আছে কিনা?
মনন : কিছু কিছু টুর্নামেন্ট, যেগুলোর প্রয়োজন ছিল না, সেগুলো করে সব টাকা শেষ করে ফেলেছে। আবার টাকা উধাও হয়ে গেছে। অকারণে কয়েকটি জিএম টুর্নামেন্ট হয়েছে, আদতে দাবাড়ুদের জন্য কোনো লাভ হয়নি।
সমকাল : দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বাংলাদেশের। অথচ ভারতে এখন ১০০ জনের মতো গ্র্যান্ডমাস্টার, যেখানে বাংলাদেশের মাত্র পাঁচ।
মনন : ভারতের চেয়ে আমরা সব বিভাগেই পিছিয়ে আছি। ভারতে দাবা খেলাকে সবাই সাপোর্ট করে। আর বাংলাদেশে কেউ করে না। এর বাইরে স্পন্সরশিপ নেই। ভারতের প্লেয়াররা প্রতিনিয়ত বাইরের কোচ দিয়ে কোচিং করে। তারা ভালো করবে না তো করবে কারা? তাদের পাইপলাইনে হাজার হাজার প্লেয়ার। প্রায় প্রতিদিনই তাদের প্লেয়াররা জিএম হচ্ছেন। ভারতের সঙ্গে অনেকেই বাংলাদেশের তুলনা করে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা করা ঠিক না। আমি একটা জিনিস বলব, বাংলাদেশে সবাই প্রশ্ন করে কেন সিজিএম (সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার) হচ্ছে না। আমাদের যারা গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন, তারা আসলে কী পাচ্ছেন? কেউই সে রকম কিছু পাচ্ছেন না। তাদের কোচিং করিয়ে, বিভিন্ন উপায়ে আয় করতে হচ্ছে। আমি মনে করি, যারা জিএম, তাদের মাসিক একটা বেতন দেওয়া উচিত। এটা ভারতে অনেকেই পান। দুই বছরের জন্য যদি স্পন্সর পাই, তাহলে এক বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারব।
সমকাল : ক্রিকেট-ফুটবলের চেয়ে দাবার প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকার কারণ কী?
মনন : দাবাতে আসলে কোনো দর্শক নেই। ক্রিকেটে যেমন গ্যালারিতে দর্শক থাকে, টিকিট বিক্রি করে আয় করা যায়। ক্রিকেটে বিজ্ঞাপন আছে, সবাই এই খেলার প্রতি আগ্রহী। দাবাতে সাধারণ দর্শক আগ্রহী নয়। একটা চাল দিতে এক ঘণ্টা লাগছে, তাহলে কে এই খেলা দেখতে বসে থাকবে? বাংলাদেশে দাবাকে কেউ মূল্যায়ন করে না, যেটা ভারতে করে।
সমকাল : দাবায় এমন কোনো চাল আছে কিনা, যেটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল?
মনন : থাইল্যান্ডে ভালো করার পরই আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সেখানে প্রথম আইএম নর্মটা পেয়েছিলাম। বলতে পারেন ২০২৩ থাইল্যান্ডের ওই টুর্নামেন্টই আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
সমকাল : শুনেছি প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন...
মনন : আমি তাঁর (জিয়া) বাসায় থেকে ১২ দিন ক্লাস করেছিলাম। কখনও মেসেজের মাধ্যমে, আবার কখনও বা সামনে পেলেই দাবা নিয়ে পরামর্শ দিতেন। আমার এই পর্যায়ে আসার পেছনে তাঁরও অনেক অবদান আছে। তাঁর চলে যাওয়াটা দাবার জন্য অনেক বড় ক্ষতির। আমি আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব পেলাম, তিনি বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল, তিনি থাকলেও জানাতেন। স্যারের কাছ থেকে অভিনন্দন পাওয়াটা একটা গর্বের বিষয়।
- বিষয় :
- মনন রেজা নীড়
- দাবা