ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার

‘নারী ফুটবলকে ব্র্যান্ড হিসেবে নিতে হবে’

‘নারী ফুটবলকে ব্র্যান্ড হিসেবে নিতে হবে’

সাবেক নারী ফুটবলার ও কোচ মাহমুদা খাতুন অদিতি।

সাখাওয়াত হোসেন জয়

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪ | ১৭:৪৫

শৈশবে পাড়া-মহল্লায় গিয়ে ছেলেদের সঙ্গেও ফুটবল খেলেছেন। ফুটবলের প্রতি এতটাই ভালোবাসা ছিল তার, কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। শৈশব পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে ওঠার পর খেলাধুলা নিয়ে ঠিকই আপত্তি তোলে মাহমুদা খাতুন অদিতির পরিবার। শেষমেষ মেয়ের দুরন্তপনা আর অদম্য আগ্রহের কাছে হার মেনে মা-বাবা তার ফুটবল খেলার ব্যাপারে সায় দেন। গাইবান্ধা পৌর শহরের পলাশপাড়ায় বেড়ে ওঠা অদিতি প্রথম নারী ফুটবল লিগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সিতে প্রথম ম্যাচেই করেছিলেন ডাবল হ্যাটট্রিক। ২০০৮ সালে জাতীয় নারী ফুটবল দলের হয়ে স্বর্ণপদক জেতা অদিতি বসুন্ধরা কিংসের নারী দলের প্রধান কোচ ছিলেন। তার অধীনে ক্লাবটি হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফুটবলের মাঠ থেকে কোচিং; সব জায়গায় সাফল্য পাওয়া সাবেক এ ফুটবলার ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচিত হলে ফুটবল নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা মাহমুদা খাতুন অদিতি তুলে ধরেছেন সমকালের সঙ্গে। শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়

সমকাল : বাফুফে নির্বাচনে জিতলে ফুটবল নিয়ে কী পরিকল্পনা আপনার?

অদিতি : আমার পুরো জীবনটাই ফুটবলের পিছনে ব্যয় করেছি। মাঠ থেকে শুরু আমার। সেই ধারা এখনো ধরে রেখেছি। খেলোয়াড়, সংগঠক এবং কোচ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে আমার। এই সব কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটা আমি ফুটবল ফেডারেশনে কাজে লাগাতে চাই। আমি মনে করি নারী ফুটবলারদের জন্য একজন পরিপক্ক, মাঠ থেকে উঠে আসা প্রতিনিধি দরকার। নারী ফুটবল নিয়ে আমার অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। আমার একটা হোমওয়ার্ক আছে, কৌশল আছে। আমি নারী ফুটবল নিয়ে অনেক হোমওয়ার্ক করেছি। আমি একমাত্র মেয়ে যে শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত ফুটবলের সঙ্গে আছি। কোনো কোনো প্লেয়ার অবসর নিয়ে ঘর সংসার করছে। সংসার আমারও আছে, তবে সবকিছুর আগে আমি ফুটবলকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছি। আমি কিন্তু হারিয়ে যাইনি। যেহেতু আমি তৃণমূল থেকে এই পর্যায়ে এসেছি, সেহেতু আমি জানি নারী ফুটবলের সমস্যাগুলো কোথায়। এই সমস্যাটা বের করে এটার সমাধান করব। আমি যদি নির্বাচিত হই, তাহলে কাজ করার মাধ্যমে আমার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করব।

সমকাল : ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে বসুন্ধরা কিংস নারী দলের কোচ ছিলেন। মেয়েদের ফুটবলের কোন জায়গাটা পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

অদিতি : বাংলাদেশে যেসব মেয়ে ফুটবল খেলেছে, তারা ফুটবলের নেশায় খেলছে। এখানে পেশাদারিত্ব আনতে হবে। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। নারী ফুটবলকে পণ্য হিসেবে আনতে হবে। একটা মেয়ে ফুটবলে আসল, শুধু খেলেই গেলো, পত্রিকায় ভালো ছবি আসলো, টিভিতে নিউজ হলো, আমি মনে করি এতে সেই মেয়েটির কোনো লাভ হলো না। বাংলাদেশের ফুটবলেরও কোনো লাভ হলো না। মেয়েরা খেলা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আর খোঁজ কেউ নেয়না। আমরা একটা গাছকে পরিচর্যা করি, তারপর সেই গাছ থেকে ফল পাই। ওই ফল আমরা বিক্রি করি। নারী ফুটবলকেও সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব এবং একটা পণ্য হিসেবে চিন্তা করতে হবে। শুধু আসলো বাফুফে ভবনের ওপরে থাকলো, কয়েকজন খেললো এইভাবে তো নারী ফুটবল চলতে পারে না। পুরো নারী ফুটবলকে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করতে হবে। আচরণ থেকে মাঠ, তাদের একাডেমি, শিক্ষা থেকে ডাইনিং সাইড, সবকিছুতে তাদের নার্সিং করতে হবে, যেখানে অবাধে চলাফেরার ব্যবস্থা করতে হবে।

সমকাল : সেক্ষেত্রে নারী ফুটবলকে তো তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে?

অদিতি : এটা ঠিক। এখন যেমন হান্টিং করে কিছু মেয়েকে একসঙ্গে বাফুফেতে রাখছি। যদি বিভাগীয়ভাবে নারী ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারি, তাহলে সেখান থেকে অনেক ফুটবলার বের হয়ে আসবে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে কোন বিভাগ থেকে কোন ডিএফএর অধীনে কারা জাতীয় দলের জন্য কয়টা মেয়েকে দিতে পারছে। এই দায়ভার বিভাগগুলোকে দিয়ে দেই, আমার এত টেনশন করার দরকার নেই।

সমকাল : তাহলে বাফুফে ক্যাম্পে কেন মেয়েদের রাখা দরকার?

অদিতি : প্রাথমিক যাছাই-বাছাই ওখানে হবে। মানুষের আগ্রহ বাড়বে। আমি যদি রংপুরে জায়গা নিয়ে একটা ক্যাম্পের ব্যবস্থা করি। তাহলে রংপুরে যে ৮টা জেলা থেকে কমপক্ষে ৮০টা ফুটবলার আমি পাবো। মেয়েরা ফুটবল খেলতেছে। এখান থেকে যদি জেলা পর্যায় থেকে পাঁচটা প্লেয়ার পাই, তারপর ৪০ জনকে নিয়ে ক্যাম্পিং করি। সেখান থেকে ৫ জন ঢাকাতে ক্যাম্পের জন্য পাঠালেই তো হলো।

সমকাল : নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই ফুটবলে আসছে। বিত্তবানরা কিন্তু আসছে না। এটা নিয়ে কী পরিকল্পনা আছে আপনার?

অদিতি : ৫০০ টাকায় আগে যে দিনমজুর পেতাম; এখন সেই টাকায় পাইনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে ;কিন্তু মেয়েদেরকে নারী বলেই মনে করছি। বৈষম্য দূর করতে হবে। সুবিধা বাড়াতে হবে। তাহলে এলিট পরিবারের বাচ্চারা ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ওদের যদি আয়ের উৎস দুই টাকা থাকে, তাহলে এক টাকার জন্য কেন যাবে? এটাকে প্রচার করতে হবে। নারী ফুটবলকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে নিতে হবে। সবাই তো ক্রিকেট খেলতে চায়, কারণ ক্রিকেট একটা ব্র্যান্ড। ফুটবল সবাই পছন্দ করে; কিন্তু খেলতে আসে না। তাহলে ফুটবলটাকে আমাদের ওইভাবে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। 

সমকাল : বাফুফেতে নারী দলের আবাসিক ক্যাম্প নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে।

অদিতি : ফুটবল ফেডারেশনে নারী দলটা সম্পূর্ন ভিন্ন একটা জায়গায় থাকুক এটা আমি চাই। বাফুফে ক্যাম্পে এভাবে মেয়েদেরকে রাখতে আমি রাজি না। আমি বাফুফেতে মেয়েদের আবাসিক ক্যাম্পে গিয়েছি। একটা রুমের মধ্যে কয়েকজন মিলে থাকে;যেটা দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। মাঠ, একাডেমি, ওদের হাঁটা-চলা-খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই ভিন্ন জায়গায় নিয়ে করতে হবে। বসুন্ধরা কিংসে তো অনেক সুবিধা আছে। চাইলে অনেক কিছু সম্ভব হবে। একদম যে জায়গা কিনে ভবন করতে হবে তার দরকার নেই। বসুন্ধরার অনেক মাঠ আছে। এটা শুধু স্বদিচ্ছা আর এটার পিছনে একজনকে লেগে থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

×