ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

ওয়াশব্লক প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

ওয়াশব্লক প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

ওসমানীনগরের ঈসাগ্রাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অসমাপ্ত ওয়াশব্লক। ছবি: সমকাল

মো. আনোয়ার হোসেন আনা, ওসমানীনগর

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | ০৩:৪২

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি)-৪-এর আওতায় সারাদেশের মতো সিলেটের ওসমানীনগরের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অসম্পন্ন কাজ হস্তান্তর, টাকা উত্তোলন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, কাজে ত্রুটি ও দীর্ঘ দিন ধরে কাজ ফেলে রাখা মতো বিষয়গুলোই অভিযোগের মূল ক্ষেত্র।

জানা গেছে, নামে মাত্র ঠিকাদার নিয়োগে কৌশলে নিজের হাতে রেখে এসব প্রকল্পের কাজ করাচ্ছেন উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী; যার কারণে প্রকল্পের সবকিছু তাঁর ইশারাতেই চলছে, কাজের অগ্রগতি না থাকলেও টাকা উত্তোলনে এগিয়ে। অনেক প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই অনুরোধের সুরে রীতিমতো চাপে রেখে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছ থেকে কাজ হস্তান্তর নথিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

এদিকে এসব অভিযোগ ও প্রকল্পের তথ্য যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধানে গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে। সাড়া দিচ্ছেন না শীর্ষ কর্মকর্তারাও। তথ্য সংগ্রহে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দপ্তরে গেলে ওয়াশব্লকের ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ দেননি সেখানে কর্মরতরা। পরে যোগাযোগ করা হয় জেলা অফিসে। সেখান থেকে ৪ মাস আগের তথ্য পাওয়া কিছু তথ্য দেওয়া হয়।

জেলা অফিসের প্রকল্প অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৪ মাস আগের এসব তথ্য ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। এতে যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে কাজের অগ্রগতি শূন্যের কোঠায় বা আংশিক হয়েছে বলে জানা গেছে। কাজই হয়নি এমন একাধিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক ক্ষেত্রে অগ্রগতির হার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশও দেখানো হয়েছে নথিতে। 

এমন বিষয় নিয়ে উপজেলা বা জেলা অফিসে গেলে কথা বলতে রাজি হননি কর্তব্যরতরা। 

সিলেট জেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পিইডিপি-৪-এর আওতায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে পৃথক ৪টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার ৭৭৩ টাকায় ৬৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লকের নির্মাণকাজগুলো পায় সোনালী সিন্ডিকেট, এটিএম জেবি, সেতু এন্টারপ্রাইজ ও সাদেকুর রহমান নামের চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৪টি প্যাকেজে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৬১২ টাকা মূল্যের ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণকাজ রয়েছে ওসমানীনগর উপজেলায়। ঠিকাদাররা কাজ পেলেও প্রকল্পের নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছেন না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সোনালী সিন্ডিকেটের প্যাকেজে ২০টি ওয়াশব্লক কাজের ১৫টিই ওসমানীনগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মাণ হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ঈসাগ্রাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আহমদনগর ওয়াজেদ আলী, হজরত শাহ তাজউদ্দিন (র.), সুন্দিলখলা, হাজী মোহাম্মদ মোবারক আলী ও পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। 

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কাজ শুরু না হলেও উল্লিখিত বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণ কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পন্ন ওয়াশব্লকের অগ্রগতি দেখানো ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। এমন মনগড়া তথ্যের প্রতিবেদন দাখিল করে প্রকল্পের ১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বিল এরই মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে; যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৫৫ শতাংশ।

মোহাম্মদ মোবারক আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ আচার্য বলেন, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে অনেকবার যোগাযোগ করলেও কোনো সুফল পাননি বলে জানান তিনি। এদিকে এখনও কাজ শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান। 

একই অর্থবছরে ১৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ পায় এটিএম জেবি। তাদের প্যাকেজে ১৫টি ওয়াশব্লকের মধ্যে ৫টি ওসমানীনগরে। এই প্রকল্পের কাজগুলো শতভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো টাকা উত্তোলনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলে শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি। এই প্যাকেজের এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। 

সাদেকুর রহমান ঠিকাদারের প্যাকেজে উপজেলায় ৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়াশব্লকের কাজ রয়েছে। শতভাগ কাজ সম্পন্ন না করেই সুকৌশলে কাজগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা। কাজ বুঝে পাওয়ার নথিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা স্বাক্ষর দিতে না চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অনুরোধপূর্বক স্বাক্ষরে ‘বাধ্য’ করেন।

নিজ করনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণেশ রঞ্জন বলেন, কাজ শেষ না করে হস্তান্তরের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিতে এলে তিনি সম্মত হননি। এক পর্যায়ে কমিটির সহসভাপতির কথায় এবং উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর অনুরোধে স্বাক্ষর করেন।

সেতু এন্টারপ্রাইজের ১৫টি ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজসহ প্রকল্পের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ। যেটুকু হয়েছে তাও নিম্নমানের। একই অভিযোগ মুক্তারপুর ও কাগজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

এছাড়া হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেট নির্মাণ প্রকল্পের সাদিপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, প্রথমপাশা জামেয়া মোহাম্মদিয়া আবাসিক মাদ্রাসা, খাইয়া খাইড় হাফিজিয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, ময়নাবাজার ও হাজীপুর বাজারের নির্মাণাধীন ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটগুলো নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা এ ব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসে ধরনা দিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছেন না। অথচ প্রকল্পের টাকা উত্তোলন শেষ।

রংবরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেফায়েত উল্লাহ বলেন, ওয়াশব্লকের কাজে অসংখ্য অনিয়ম। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এবং শিক্ষা অফিসে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা হাদিউল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন করে মন্তব্য বইতে এ নিয়ে মন্তব্য লিখে গেছেন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে তিনি নিজে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ বিলম্বের ব্যাপারে মৌখিক অভিযোগ ছিল। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দ্রুত সে কাজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

সোনালী সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন বলেন, তাঁর কাজগুলো করছেন মুরাদ নামের একজন। ঠিকাদার সাদেকুর রহমান বলেন, ওসমানীনগরের কাজগুলো অনেক আগেই শেষ। এর বেশি কিছু বলেননি। সেতু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ তৈমুর বলেন, তাঁর কাজ ওসমানীনগরে দেখেন উজ্জ্বল। এর বাইরে আর কোনো তথ্য দেননি তিনি। 

ওসমানীনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সানাউল হক সানি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কাজ বা সমস্যা আছে তা তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসের অনিয়মের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করছেন কিনা, তা জানা যায়নি।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ দিদারুল ইসলাম কায়েস তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বন্যার কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন। এখন তারা আবার কাজ শুরু করবেন।’

কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুললে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘কাজগুলো তো করে দেওয়া হবে।’ তাঁর মন্তব্যে কাজ না করে আগাম অগ্রগতি প্রতিবেদনে বানোয়াট তথ্য উপস্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তবে নিজেই কাজগুলো করাচ্ছেন, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

সিলেট বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মুহাম্মদ শেখ সাদি রহমত উল্ল্যাহ বলেন, বিষয়টি নোট করে রেখেছেন। এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×