ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গৌতম ঘোষ

ভেতরে যদি আনন্দ না থাকে তাহলে বেঁচে থাকা অর্থহীন

ভেতরে যদি আনন্দ না থাকে তাহলে বেঁচে থাকা অর্থহীন

গৌতম ঘোষ। ছবি: কান কর্তৃপক্ষ

অনিন্দ্য মামুন, কান (ফ্রান্স) থেকে

প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫ | ১৩:৫৭ | আপডেট: ২১ মে ২০২৫ | ১৪:৫২

নিজের সিনেমা ‘পরিক্রমা’ নিয়ে এবার ৭৮তম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। উৎসবের মার্সে দ্য ফিল্ম বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটি। পরিক্রমা দেখতে গিয়েই সাক্ষাৎ মেলে এ নির্মাতার সঙ্গে। কথা হয় তাঁর বারবার কানে আসার অভিজ্ঞতা, নতুন সিনেমা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে।

প্রশ্ন: এবারের কান ফেস্টিভ্যালে এসে কেমন দেখছেন?
গৌতম ঘোষ: খুব ভালো লাগছে। কান আমার কাছে শুধু একটা উৎসব নয়; বরং আমার কাছে দ্বিতীয় ঘরের মতো। এতবার এসেছি এখানে, পুরোনো স্মৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াই। পরিচিত অনেক মুখের সঙ্গে দেখা হয়, নতুন নতুন উদ্যোগ আর মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়– সব মিলিয়ে এ প্রাণবন্ত পরিবেশটা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করে।

প্রশ্ন: কানের মার্সে দ্য ফিল্ম বিভাগে ‘পরিক্রমা’ নিয়ে এসেছেন। সিনেমাটি নিয়ে কানের অভিজ্ঞতা কেমন হচ্ছে?
গৌতম ঘোষ: এককথায় দারুণ! উৎসবের বাণিজ্যিক বিভাগে স্ক্রিনিং হয় সিনেমাটির। সিনেমাটি দেখতে হলভর্তি ছিল দর্শক। স্ক্রিনিং হয়েছে সকালে। এত সকালে এত মানুষ আসবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। আগত সবার এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে আমি অভিভূত! ইউরোপিয়ান ডিস্ট্রিবিউটররা এ স্ক্রিনিং আয়োজন করেছিল। ইতোমধ্যে অনেক জায়গা থেকে ছবিটি বিক্রির আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন: ‘পরিক্রমা’ তো প্রথম ইন্দো-ইতালিয়ান যৌথ প্রযোজনা এবং ভারতীয় সরকারের কো-প্রোডাকশন অনুদান পাওয়া ছবি?
গৌতম ঘোষ: হ্যাঁ, এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়ও। এই অনুদান পাওয়া সহজ নয়। অনেকেই জানতে চান কীভাবে অনুদান পাওয়া যায়, আর আমার সিনেমা সেই পথ দেখাচ্ছে। এ ছবির মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন দরজা খুলে দিয়েছি।

প্রশ্ন: ১৯৮২ সাল থেকে কানে আসছেন, তখন আর এখনকার কান উৎসবের মাঝে কোন বিষয়টি আলাদা মনে হচ্ছে?
গৌতম ঘোষ: ১৯৮২ সালে ‘দখল’ নিয়ে প্রথম এসেছিলাম, তখন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, আদুর গোপালকৃষ্ণদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। তখন উৎসবটা ছিল শিল্পের আসর, এখন বাণিজ্যের দিকটা অনেক বড় হয়েছে। ডিজিটালের যুগে সিনেমার বাজারও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তবে সেই পুরোনো ব্লু বারে বসে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি আজও আমার হৃদয়ে অমলিন।

প্রশ্ন: নিজ দেশের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে আপনার দীর্ঘ সম্পর্ক। কানের অভিজ্ঞতা থেকে সেসব ফেস্টিভ্যালের জন্য কী শিক্ষা থাকতে পারে?
গৌতম ঘোষ: কানকে অনুকরণ করা সহজ নয়, কারণ এটা শতাব্দীর ঐতিহ্য আর পরিকল্পনার ফল। তবে আমরা শিখতে পারি কীভাবে শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায় এবং আন্তর্জাতিক মানের উৎসব তৈরি করা যায়। আমি সবসময় চাই আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুক। সুযোগ পেলে আবার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক।

প্রশ্ন: কানের আবহাওয়া কেমন লাগে?
গৌতম ঘোষ: (হেসে) এককথায় অসাধারণ। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের শুরু, দিনভর সূর্য আর মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি। সন্ধ্যার পর মৃদু হাওয়া বইতে থাকে, সূর্য প্রায় রাত ৯টায় ডুবে যায়। রাতজুড়ে চলে আলোচনার আসর আর পার্টি। বিশ্বজুড়ে সেরা মানুষের সঙ্গে গল্প করতে পারা, সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা ভাগাভাগি– এই অভিজ্ঞতা শুধু কানেই পাওয়া যায়।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য কিছু বলার আছে?
গৌতম ঘোষ: হ্যাঁ থাকবে না কেন। আমরা তো একই ভাষার। দেখো, নিজের দেশ ছেড়ে এত দূরে এসেও আমরা একই ভাষায় কথা বলছি। তার মানে আমরা একই। আমিও তো তোমাদের মতো বাংলাদেশেরই লোক। বাংলাদেশ নিয়ে আমার কত স্মৃতি, কত কত ভালোলাগা। এসব অল্প সময়ে বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের সবার প্রতি রইল ভালোবাসা। তোমরা ভালো থেকো, কানে থেকো, সিনেমা উপভোগ করো।

প্রশ্ন: একটু অন্য বিষয়ে জানতে চাইব, মানুষ হিসেবে আপনার জীবন দর্শন কী?
গৌতম ঘোষ: এটা বলা কঠিন। কারণ মানুষের জীবনের দর্শন ব্যখ্যা ও বিশ্লেষণ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা কঠিন। জীবনের দর্শনটা হচ্ছে মানব দর্শন। এই পৃথিবীতে আমরা যে বাস করি যে প্রকৃতি আমাদের আশ্রয় দেয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা সুন্দর জীবনযাপন করাই জীবন দর্শন। মোট কথা, জীবকে অর্থবহ করে আনন্দে কাটিয়ে দেওয়া। বাঁচতে যেহেতু হবে আনন্দেই বাঁচি। সেই আনন্দের রঙ্গ নানারকম হতে পারে। কেউ বিরহে আনন্দ পান কেউ আবার হাসিতে আনন্দ পান।  নিজের ভেতরে যদি আনন্দ না থাকে তাহলে বেঁচে থাকা কষ্টকর ও অর্থহীন মনে হবে।

প্রশ্ন: আপনি স্বনামধন্য বাঙালি পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্বপ্রান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটকরা বাংলা চলচ্চিত্রকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেই জায়গাটা কী ধরে রাখা যাচ্ছে আজকাল?
গৌতম ঘোষ: প্রশ্নটির উত্তর দীর্ঘ করে দিতে হবে। কিন্তু অতটা সময় এখন দেওয়া যাবে না। অন্য এক জায়গায় সময় দেওয়া আছে। তারপরও বলি, আমাদের জেনারেশন যে ছবিগুলো করেছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে কিংবা প্রশংসিত হয়েছে।  সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন অথবা ঋত্বিক ঘটকের বহু ছবি চলেছে, আবার বহু ছবি সেই অর্থে চলেনি। জনপ্রিয়তা ও ব্যবসার ওপর সব সময় চলচ্চিত্র নির্ভর করে না। একটি চলচ্চিত্র ব্যবসা দিতে পারে, আবার নাও দিতে পারে। কোনো দিনও আমাদের বাংলা ছবির বড় বাজার ছিল না। অন্য ইন্ডাস্ট্রির মানুষরা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে গোটা পৃথিবীতে। আমরা বাঙালিরা পারিনি। এটা কিন্তু ভাববার বিষয়। অসংখ্য ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে। অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, কলাকুশলীর অভাব নাই। কিন্তু আমরা যদি ছবির বাজারটা না বাড়াই তাহলে সব ট্যালেন্ট অংকুরেই বিনষ্ট হবে। তাই এখন নিজেরাই মাঠে নেমেছি। বাজার বড় করার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস, এই প্রজন্মও এদিকে খেয়াল রাখবে। 
 

আরও পড়ুন

×