ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

কার গুদামে কত পেঁয়াজ

কার গুদামে কত পেঁয়াজ

পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। বাজারের চলমান অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলায় মঙ্গলবার চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে অভিযান চালানো হয়- সমকাল

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম ও আবদুর রহমান, টেকনাফ

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:৪০

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কক্সবাজারের ৩৫ ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করছেন পেঁয়াজের বাজার। এসব ব্যবসায়ীর গুদামে রয়েছে আমদানিকৃত বেশিরভাগ পেঁয়াজ। এদের একটি অংশ মজুদ করেছে দেশি পেঁয়াজ। আরেকটি অংশ মজুদ করেছে মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ। আরেকটি গ্রুপের কাছে আছে মিসর ও তুরস্ক থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ। বাজার বুঝে গুদাম থেকে পেঁয়াজ বের করছেন তারা। তাই পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানির পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না বাজার।

কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে গতকাল মঙ্গলবারও ৫৭০ টন পেঁয়াজ এসেছে। একই রুট দিয়ে আগের দিন সোমবারও এসেছে ৫৩৬ টন পেঁয়াজ। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে টানা দু'দিন এক হাজার টনেরও বেশি পেঁয়াজ আমদানির ঘটনা এটিই প্রথম। প্রসঙ্গত, গত এক মাসে এ রুট দিয়ে তিন হাজার ৫৭৩ টন পেঁয়াজ এসেছে। স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার পর এক মাসে এত পেঁয়াজ আগে কখনোই আসেনি। চট্টগ্রাম  বন্দর দিয়েও গত দু'দিনে এসেছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ পেঁয়াজ।

বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আসার পরও কারা সেটি গুদামজাত করছে, কেন পেঁয়াজের দাম এভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে কঠোরভাবে কাজ করছে না মনিটরিং টিম। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত দেখা মেলেনি মনিটরিং টিমের কাউকে। তবে গতকাল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। ৪২-৪৩ টাকায় কেনা পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে হাতেনাতে প্রমাণও পেয়েছেন তারা। এভাবে অধিক মুনাফায় আর পণ্য বিক্রি করবেন না বলে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন। যতক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, ততক্ষণ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় কিছু পেঁয়াজ বিক্রিও করেছেন তারা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট যাওয়ার পর আবার ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে পেঁয়াজ। গতকাল সতর্ক করেই খাতুনগঞ্জে অভিযান সীমাবদ্ধ রেখেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু খাতুনগঞ্জে যারা পণ্য গুদামজাত করেছে, গতকালও হানা দেওয়া হয়নি তাদের গুদামে।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'সোম ও মঙ্গলবার টানা দু'দিন সতর্ক করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। সিন্ডিকেট করে তারা যে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন, হাতেনাতে এর প্রমাণও পেয়েছি। ৫০ থেকে ৬০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। কঠোরভাবে এটি মনিটর করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত চলে আসার পর যারা ফের দাম বাড়িয়েছেন, তাদের তথ্যও সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা।' বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের অধীনে এ অভিযান পরিচালনা হয়েছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'জেলা প্রশাসনের অধীনেই অভিযান চালানো হয়েছে। মনিটরিং টিমের সঙ্গে এ আদালতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।' জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করছে এএইচএম আহসান। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে শাখা এফটিএ-১-এর যুগ্ম সচিব।

কার গুদামে কত পেঁয়াজ :ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিয়ানমারের ১০-১২ ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচ ব্যবসায়ীর কাছে আছে আমদানিকৃত পেঁয়াজের ৮০ শতাংশ। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে গতকাল মঙ্গলবারও ৫৭০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।

এর মধ্যে এমএস ট্রেডিংয়ের মালিক মো. হাসেমের কাছে আছে ১৯৯ দশমিক ৬৮০ টন, নুরুল কায়েস সাদ্দামের কাছে ৯৯ দশমিক ৮০০ টন, জিন্নাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক শওকত আলমের কাছে ৫৯ দশমিক ৮৮০ টন, এশিয়া এন্টারপ্রাইজের সাইফুদ্দিনের কাছে ৫৯ দশমিক ৮৮০ টন, মো. নাছিরের কাছে ৩১ দশমিক ৯০ টন, কেএম ট্রেডিংয়ের মালিক মো. আলম বাহাদুরের কাছে ১৯ দশমিক ৬০০ টন, গ্লোবাল লজিস্টিক ইন্টারন্যাশনালের কাছে আছে ৯৯ দশমিক ৮০ টন পেঁয়াজ।

সোমবার আসা ৫৩৬ টন পেঁয়াজের মধ্যে যদু চন্দ্র দাশের কাছে আছে ১১৮ দশমিক ৫০ টন, শওকত আলমের কাছে সাড়ে ৬৬ টন, আরাফাতের কাছে ৫৫ দশমিক ৩৫ টন, সাইফুদ্দিনের কাছে ৫০ টন, আবু আহমদের কাছে সাড়ে ৪০ টন এবং মহসিনের কাছে সাড়ে ১৭ টন পেঁয়াজ। গত এক মাসে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসা তিন হাজার ৫৭৩ টন পেঁয়াজও ঘুরেফিরে এনেছেন এই ১০-১২ ব্যবসায়ী। মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের এখন ৮০ শতাংশ মজুদ আছে তাদের কাছে।

আমদানিকারকদের সঙ্গে কারসাজি করে খাতুনগঞ্জে যেসব কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছে- মেসার্স হাজি অছিউদ্দিন সওদাগর, মেসার্স আবদুল আউয়াল, মেসার্স শাহজালাল ট্রেডার্স, মেসার্স বাগদাদী করপোরেশন, এসএন ট্রেডার্স ও সোনালি ট্রেডার্স। তাদের কাছে এখন মজুদ আছে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তুরস্ক ও মিসর থেকে আসা পেঁয়াজের মজুদ আছে তিন ব্যবসায়ীর কাছে। তাদের মধ্যে ঢাকার হাফেজি করপোরেশনের কাছে ১৩০ টন, জেনি এন্টারপ্রাইজের কাছে ১৫৬ টন ও এনএস ইন্টারন্যাশনালের কাছে আছে ৭৮ টন পেঁয়াজ। দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের সবচেয়ে বেশি মজুদ আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবনগর এলাকার মেসার্স টাটা ট্রেডার্স, সাতক্ষীরার মেসার্স দীপা এন্টারপ্রাইজ, রিপা ট্রেডার্স ও ঢাকা ট্রেডার্সে। পেঁয়াজ মজুদ রেখে এরা তা বেশি দামে বিক্রি করতে কমিশন এজেন্টদের বাধ্য করছে বলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছেও স্বীকার করেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন চিত্র :খাতুনগঞ্জে অভিযান চালিয়ে পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের ভয়াবহ কারসাজি দেখতে পেয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট। মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পেঁয়াজ ক্রয়মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি দামে বিক্রির প্রমাণও পেয়েছেন তারা। মেসার্স অছিউদ্দিন ট্রেডার্স মিয়ানমার থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ সোমবার কিনেছে ৪২ টাকায়। কিন্তু তারা তা বিক্রি করছিল ৭৫ থেকে ৮৯ টাকায়। মেসার্স আবদুল আউয়ালের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৪২ টাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর ৫৬ টাকা, ২৪ সেপ্টেম্বর ৬০ টাকা, এর দু'দিন পর ৫৮ টাকা ও গত রোববার ৫২ টাকা বিক্রি করে। কিন্তু সোমবার একই পেঁয়াজ ৯০ টাকা দরে বিক্রি করেছে তারা। আর শাহজালাল ট্রেডার্সের নথিতে দেখা যায়, ২৫ ও ২৮ সেপ্টেম্বর তারা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছে ৬০ টাকা দরে। কিন্তু এখন বিক্রি করছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। একই চিত্র ছিল বাগদাদী করপোরেশন ও এসএন ট্রেডার্সেও।

বেশি দামে বিক্রি না করার মুচলেকা দিলেন ব্যবসায়ীরা : কম দামে কেনা পেঁয়াজ আর বেশি দামে বিক্রি করবেন না বলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজের দাম তাৎক্ষণিকভাবে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা কমিয়ে বিক্রি করেন তারা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট যাওয়ার পর আবার পাইকারি মোকামে বাড়তি দামে বিক্রি হতে থাকে পেঁয়াজ। অথচ কম দামে কেনা পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি করা হবে না বলে গতকাল মুচলেকা দেন হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এদিকে আদালতের কাছে মুচলেকা দেওয়া প্রসঙ্গে হামিদ উল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস মিয়া বলেন, 'খাতুনগঞ্জে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মেসার্স হাজি অছি উদ্দিন ট্রেডার্স কম দামে পণ্য বিক্রি করবে বলে মুচলেকা দিয়েছে আদালতকে। এতে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছে আড়তদার সমিতি। পরে মেসার্স খাজা ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।' মেসার্স হাজি অছি উদ্দিন সওদাগরের পক্ষে মুচলেকায় স্বাক্ষর করে মো. রিগ্যান। মুচলেকায় তিনি উল্লেখ করেন, 'সরকারনির্ধারিত স্বাভাবিক বাজারমূল্য থেকে অতিরিক্ত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করব না। যদি অতিরিক্ত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করি তাহলে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী যে কোনো শাস্তি মেনে নিতে বাধ্য থাকব।' চাকতাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম এ মুচলেকায় সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন। তিনি বলেন, 'আমদানিকারকরা বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বিক্রেতাদের চাপ দিচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরার কয়েকজন আমদানিকারক বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি না করলে ভবিষ্যতে মাল দেবে না বলেও সতর্ক করেছেন। আমদানিকারকের কাছ থেকে বেশি দামে পণ্য কিনলে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।' টেকনাফ স্থলবন্দরের অন্যতম পেঁয়াজ আমদানিকারক শওকত আলম বলেন, 'আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পেঁয়াজ আমদানি করি। নূ্যনতম লাভে এটি বিক্রি করা হয়। কারসাজি হয় পাইকারি পর্যায়ে।'

আরও পড়ুন

×