শেষবিদায় বেলায়ও সন্তানকে ছুঁতে পারেননি বাবা-মা

যশোর অফিস
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২২ | ০৫:৫৭ | আপডেট: ০৬ জুন ২০২২ | ০৫:৫৮
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনা ফেসবুকে লাইভ করার সময় নিহত হন ইব্রাহিম। সোমবার ভোরে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি বাঘারপাড়া নরসিংহপুর গ্রামে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল ওঠে নিহতের বাড়িতে। ভোরের নীরবতা ভেঙে কান্নার শব্দ ছাপিয়ে যায় বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গ্রামে।
কয়েক শ মাইল দূরে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জীবন দেওয়া সন্তানের শেষবিদায় বেলায়ও কাছে পেয়েও স্বভাবসুলভভাবে ছুঁতে পারেননি বাবা আবুল কাশেম মুন্সী, মা দুলাপি বেগম ও তাদের স্বজনেরা। কেননা তাদের ছেলে ইব্রাহিমের সুঠাম দেহ যে অর্ধপোড়া। তাই দাফনের আগ পর্যন্ত ফ্রিজিং গাড়িতেই রাখা হয় ইব্রাহিমের মরদেহ। গাড়ির সাদা গ্লাসের ওপর দিয়ে পুত্রের লাশের মুখে হাত বুলিয়ে শেষ আদরও দিয়েছেন বাবা।
বারবার মূর্ছা যেতে যেতে মা দুলাপি বেগম বলেন, ‘ওরে আল্লাহ রে...আমি কী করব? তুমি আমার কী পরীক্ষা করতিছাও? তুমি আমার সন্তানরে ফেরায়ে এনে দাও আল্লাহ রে...। সে খুব আদরের। আমি কার নিয়ে বাঁচব। ওর ঘরে যে পোয়াতি (অন্তঃসত্ত্বা) বউ রয়েছে। প্রথম বাপ (বাবা) হবে আমার ইব্রাহিম। সন্তানের মুখ দেখতে পেল না আল্লাহ রে...। ওর জায়গায় তুমি আমারে নিতে পারলে না কেন! পাশেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে বাবা অবসরপ্রাপ্ত মাদরাসা শিক্ষক আবুল কাশেম।
এদিকে, শোককে সঙ্গী করে নরসিংহপুর গ্রামের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিদায় দেন নির্মমভাবে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ইব্রাহিমকে। সকাল ১০টায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ইব্রাহিমের মৃত্যুর খবরে গত দুই দিন ধরে প্রতিবেশী ও আশেপাশের কয়েক গ্রামের লোকজন তাদের বাড়িতে ভিড় করছেন।
জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে স্ত্রী মুন্নি খাতুন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। ভাই-বোনসহ অন্যান্য স্বজনদের ক্ষণে ক্ষণে গগণবিদারী আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। বাড়ির ভেতরের বারান্দায় প্রতিবেশী নারীরা নিহত ইব্রাহিমের নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুন্নী খাতুনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বলছেন, ‘এ সময় তুমি ভেঙে পড়লে তোমার পেটের সন্তানের সমস্যা হবে।’
বারবার মুর্ছা যেতে যেতে মুন্নী খাতুন বলছেন, আমার এই জীবন রেখে কী লাভ। আমার পাখি চলে গেছে। ও আল্লাহ আমারেও নিয়ে যাও। আমার পাখিরে রেখে কীভাবে বাঁচব। আমারদের সন্তানরে নিয়ে ওর কত স্বপ্ন ছিল। এখন কী হবে!’
পাশেই বসা মুন্নীর বড় বোন রেহেনা খাতুন বলেন, মুন্নী ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আগামী ২৮ জুলাই সন্তান ভূমিষ্ঠের সম্ভাব্য দিন ছিল। শনিবার রাত ৯টায় মুন্নীসহ তার মায়ের সাথে শেষ কথা হয়। কোরবানির ঈদে বাড়ি এসে সন্তানের মুখ দেখতে চেয়েছিল। একই সাথে সন্তান ও মুন্নীরে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ছেলে হলে মাদ্রাসায় পড়াতে চেয়েছিল, হাফেজ বানাতে চেয়েছিল। আমার বোন-জামাইয়ের সেই আশা আর পূরণ হলো না।
ইব্রাহিম একট কোম্পানির এক্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের শিপিং সহকারী পদে চাকরি করতেন। একই প্রতিষ্ঠানের অন্য শাখায় কাজ করেন তার খালাতো ভাই নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ইব্রাহিম আগুনে দগ্ধ হয়। তার আগে সে বাড়িতে মা, বাবা ও স্ত্রীসহ অন্য স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে। তার মাথার পেছনে ও পেটে আঘাত লাগে। মুখ, টি-শার্ট ও মোবাইল ফোন দেখে তাকে শনাক্ত করি। উদ্ধারের সময় তার ফোনটি সচল ছিল।
আরেক খালাতো ভাই শিমুল হোসেন বলেন, শনিবার রাতে অনেকের মতো ইব্রাহিমও অগ্নিকাণ্ডের ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। কিছু সময় পর হঠাৎ ডিপোর কনটেইনারগুলোতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে তাকে পাওয়া যায়নি। পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে লাশ পাওয়া যায়। দেড় বছর আগে নিজ গ্রামেই বিয়ে করে সে। তার এমন মৃত্যুতে তার অনাগত এই সন্তানের কী হবে সেটাই ভাবছি আমরা। আল্লাহ যেন আর কারও এমন মৃত্যু না দেয়।
- বিষয় :
- সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ
- নিহত
- আহাজারি
- ফেসবুকে লাইভ