ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

লোকালয়ে চলে আসছে বাঘ অজগর কুমির

লোকালয়ে চলে আসছে বাঘ অজগর কুমির

ফাইল ছবি

মামুন রেজা, খুলনা

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজাপুর গ্রাম। এই গ্রামের হায়দার আলীর বাড়ির মুরগির খোপ থেকে গত ৭ জুন দুপুরে একটি অজগর সাপ উদ্ধার করেন সুন্দরবনের বনরক্ষীরা। ১৫ ফুট লম্বা ও ২০ কেজি ওজনের অজগরটি পরে ছেড়ে দেওয়া হয় বনে।

একই উপজেলার খেজুরবাড়িয়া গ্রামে গত ৫ মে চলে আসে সুন্দরবনের একটি বাঘ। বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘ অনায়াসে লোকালয়ে চলে আসে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। প্রায় এক সপ্তাহ বাঘটি লোকালয়ে ঘোরাফেরা করায় আতঙ্কে ছিলেন চার গ্রামের মানুষ। বাঘের আক্রমণের শিকার হয় গরু-মহিষ।

২৩ মে শরণখোলার ধানসাগর গ্রাম থেকে একটি চিত্রা হরিণ উদ্ধার করে বন বিভাগ। এর আগে ১২ এপ্রিল মোংলা উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা গ্রামের একটি চিংড়ি ঘের থেকে উদ্ধার করা হয় একটি কুমির। পশুর নদ থেকে খাল দিয়ে কুমিরটি চিংড়ি ঘেরে চলে আসে বলে ধারণা বন বিভাগের।

২০২১ সালের ১৮ জুলাই মোংলার জয়মনির ঘোল এলাকা থেকে একটি বন্য শূকর উদ্ধার করেন বনকর্মীরা।

শুধু এই পাঁচটি ঘটনাই নয়; সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন থেকে অজগর সাপ, বাঘ, হরিণ, কুমির ও বন্য শূকর চলে আসছে লোকালয়ে। অনুসন্ধান চালিয়ে এবং বন বিভাগ ও সংশ্নিষ্ট অন্যদের সঙ্গে কথা বলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসার বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে।

খাবারের সন্ধান, বন-সংলগ্ন এলাকায় লোকালয় গড়ে ওঠা এবং বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়েছে এ অবস্থার। মারাও যাচ্ছে লোকালয়ে চলে আসা বন্যপ্রাণী। তবে গত ২-৩ বছরে কত সংখ্যক বন্যপ্রাণী লোকালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই বন বিভাগের কাছে।

সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শহিদুল ইসলাম সমকালকে জানান, গত তিন মাসে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে আসা কমপক্ষে ১০টি অজগর সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো আবার বনে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে লোকালয়েও অজগর পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের অন্য তিনটি রেঞ্জের তুলনায় শরণখোলা রেঞ্জে অজগরের সংখ্যা বেশি। বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় অজগর সহজে লোকালয়ে চলে আসতে পারছে। এ ছাড়া বনের পাশেই লোকালয় গড়ে উঠেছে। সহজে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে আসছে অজগর।

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বনের মধ্যে থাকেন প্রায় ৩২ বছর। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সমকালকে বলেন, বাঘের বয়স ১২-১৩ বছর হলে তার শিকারি দাঁত পড়ে যায়। তখন হরিণ বা বন্য শূকর ধরলেও বাঘ তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। তখন খাবারের সন্ধানে মাঝে মধ্যে বন-সংলগ্ন লোকালয়ে চলে যায়।

তিনি বলেন, বাঘের তাড়া খেয়ে অনেক সময় হরিণ ও বন্য শূকর লোকালয়ে চলে যায়। শূকর কচুর লতি বা এ জাতীয় খাবার পছন্দ করে। এই খাবারের জন্যও মাঝে মধ্যে লোকালয়ে যায়। অজগর সাপ অনেক সময় জোয়ারের পানির সঙ্গে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া সহজে হাঁস-মুরগি শিকার করে খেতে লোকালয়ে যায়। আর বন-সংলগ্ন খাল দিয়ে লোকালয়ের পুকুর বা ঘেরে যায় কুমির।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির সমকালকে বলেন, সুন্দরবন থেকে কিছুদিন পরপর বাঘ, হরিণ, অজগর ও বন্য শূকর লোকালয়ে চলে আসে। মাঝে মধ্যে আতঙ্কিত গ্রামবাসী পিটিয়ে বাঘ হত্যা করে। আবার কখনও কখনও বন বিভাগ তাড়িয়ে কিংবা অচেতন করে বাঘকে বনে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একইভাবে হরিণ ও অজগর উদ্ধার করে বনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, বনে খাবার সংকট ও লোকালয়ে সহজে শিকার ধরতে পারার কারণে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসে। লোকালয়ে আসার এই প্রবণতা রোধে বন বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় লোকালয় গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া বন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণী সহজে লোকালয়ে চলে আসতে পারছে।

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসা ঠেকাতে বনের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় জাল দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর আগে ভারতের বন বিভাগ সুন্দরবনে তাদের অংশে জাল দিয়ে সুফল পেয়েছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন দুপুরে মোংলা উপজেলার খড়মা কাটাখালি গ্রাম থেকে ৮ ফুট লম্বা ও ৫ কেজি ওজনের একটি অজগর উদ্ধার করেন বন বিভাগের কর্মীরা। পরে সেটি অবমুক্ত করা হয় সুন্দরবনে। ১ জুন শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের আবদুর রাজ্জাক হাওলাদারের হাঁসের ঘরে ঢুকে পড়ে একটি অজগর। খেয়ে ফেলে ৩টি রাজহাঁস ও একটি পাতিহাঁস। খবর পেয়ে বন কর্মীরা গিয়ে ১২ ফুট লম্বা ও ১৬ কেজি ওজনের অজগরটি উদ্ধারের পর সুন্দরবনে অবমুক্ত করেন।

২৩ মে শরণখোলা উপজেলার রাজাপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় একটি অজগর। ৮ মে উপজেলার দক্ষিণ তাফালবাড়ি গ্রামের ধানক্ষেত থেকে ৬ ফুট লম্বা একটি অজগর উদ্ধার করে বন বিভাগ। ২ মে উপজেলার সোনাতলা গ্রামের একটি মৎস্য খামার থেকে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের অজগর উদ্ধার করা হয়।

চলতি বছরের ১৯ মার্চ রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা গ্রামের পুকুর থেকে একটি কুমির উদ্ধার হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল সুন্দরবনের কাছে ঘাস খাওয়ার সময় ধানসাগর গ্রামের আফজাল হাওলাদারের একটি গরু বাঘের আক্রমণে গুরুতর জখম হয়। ৩১ মার্চ দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের সোবহান হাওলাদারের একটি মহিষ খালের চরে ঘাস খাওয়ার সময় বন থেকে একটি বাঘ লোকালয়ে এসে মহিষটিকে আক্রমণ করে।

শরণখোলার ধানসাগর গ্রামের দোকানি আমিন চৌকিদার বলেন, মাঝে মধ্যে রাতের আঁধারে বন্য শূকর দলবেঁধে গ্রামে ঢুকে ফসল নষ্ট করে।

আরও পড়ুন

×