ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব নদী দিবস

'শ্রী' হারিয়েছে শ্রীমন্ত

'শ্রী' হারিয়েছে শ্রীমন্ত

বরিশালের বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শ্রীমন্ত নদী-সমকাল

সুমন চৌধুরী, বরিশাল

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৩:৫৩

ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছোট একটি সেতু অতিক্রম করতে হয়। সেতুতে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলে মনে হবে একটি মজা খালের ওপর সেতুটি নির্মিত হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বাকেরগঞ্জ শহরের বুক চিরে এঁকেবেঁকে যাওয়া এ জলাধারটি খাল নয়, একসময়ের খরস্রোতা শ্রীমন্ত নদী।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নদীর তালিকায় এখনও বাকেরগঞ্জের শ্রীমন্ত নদীর নামটি রয়েছে। দুই পাশের তীর দখল ও দূষণে নদীটির শ্রী হারিয়েছে বহু বছর আগে। এখন সেটি ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে। পৌর শহরের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর তিন কিলোমিটারের পুরোটাই দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। জনপ্রতিনিধি থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী- সবাই আছেন দখলদারের তালিকায়। শহরের মধ্যে দখলের চিত্রই বলে দেয় একটি খরস্রোতা নদীকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। মাত্র দুই দশকের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন দেখা গেছে, শহরের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুলাতলী নদী শ্রীমন্ত নদীর উৎসমুখ। শহরের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে নদীটি। শ্রীমন্ত নদী প্রায় ২২ কিলোমিটার লম্বা। তুলাতলী নদী থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত অংশটি মাঝ বরাবরে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। মূলধারাটি কানকি নামক স্থানে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের পাশ দিয়ে পায়রা নদীতে মিশেছে। অপর অংশটি বাকেরগঞ্জের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর কালিগঞ্জ, নেয়ামতি হয়ে মিশেছে বিষখালী নদীতে। পৌর শহরের জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটাত শ্রীমন্ত।

স্থানীয় বাসিন্দা কামাল হোনে হাওলাদার জানান, শ্রীমন্ত নদীর দুই তীরের বাসিন্দাদের স্যুয়ারেজ সংযোগ দেওয়া হয়েছে নদীতে। এতে নদীর পানি ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে।

বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ম্যাপ অনুযায়ী শ্রীমন্ত নদীর প্রশস্ততা স্থানভেদে ১৫০ থেকে ৬০০ ফুট। দুই যুগ আগেও এই প্রশস্ততা বহাল ছিল। তখন বাতাসে ঢেউয়ের শব্দ ভেসে বেড়াত। বাহারি পানসি, লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা ছুটত নদীর বুক চিরে। এ অঞ্চলে বড় বন্দর ও হাটবাজার নলছিটির মোল্লারহাট, মীর্জাগঞ্জের সুবিদখালী, চান্দুখালী এবং বেতাগী ও পাথরঘাটা উপজেলার পণ্যবাহী নৌযানের প্রধান পথ ছিল শ্রীমন্ত নদী। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। দখলের কবলে পড়ে শ্রীমন্ত নদী উত্তাল ঢেউ হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। এখন আর নদী আগের অবস্থায় উদ্ধার নয়, বরং দখলদারের কবল থেকে বর্তমান 'খাল'টি বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাকেরগঞ্জবাসী।

শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন দেখা গেছে, পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর দুই পাশে ১, ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জনপদ। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তুলাতলী নদীর উৎসমুখ থেকেই দখল শুরু। এই ওয়ার্ডের মৃত আবদুর রশিদ পৌর কাউন্সিলর থাকাকালীন শ্রীমন্তর উৎসমুখ দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এরপরে সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয়েছে, দখলে সরু হয়ে মৃত খালে পরিণত হয়েছে নদীটি। পৌর শহরে তিন কিলোমিটার নদীর পুরোটার চিত্র একই।

বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দেখে গেছে, নদীর দুই তীর ভরাট করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় পাকা-আধাপাকা অসংখ্য ভবন। সেতুর পশ্চিমে আল আমিন মসজিদ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে থানা ভবন পর্যন্ত ১ কিলোমিটারে আফসার মার্কেট, গাজী মঞ্জিলসহ সব পাকা-আধাপাকা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে নদী
দখল করে।

৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আমিরুজ্জামান রিপন বলেন, শ্রীমন্ত দখলদারের দলে আছেন স্থানীয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকে। ভাঙন ঠেকানোর অজুহাতে ব্লক ফেলে সৌন্দর্যবর্ধনসহ নানা ফন্দিতে নদী দখল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, শ্রীমন্তকে জীবিত করার জন্য সবার আগে সীমানা নির্ধারণ ও দখলদারদের উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। এরপরে খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দুটি কাজ করতে ব্যর্থ হলে নদীর অস্তিত্ব যেটুকু আছে, সেটুকুও হারিয়ে যাবে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আবুল খায়ের সমকালকে বলেন, শ্রীমন্ত নদী তাঁদের আওতাধীন নয়। এরপরও এটির পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁদের একটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই মাস আগে ৪ দশমিক ৪৮ মিটার খনন করেছেন। এতে পৌর শহরের অংশে পানির প্রবাহ ফিরে এসেছে।

বরিশাল পাউবোর এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, শ্রীমন্ত নদীর আগের অবস্থা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এখন যেভাবে আছে, সেটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। এ কর্মকর্তা বলেন, ৬৪ জেলায় ছোট নদী-খাল খনন ও সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের আওতায় বরিশালের অনেক নদী-খাল খননের একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের মধ্যে শ্রীমন্তও রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নদীটি খনন করা যাবে।

আরও পড়ুন

×