ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মমতা

বয়স্কদের আপন ঠিকানা 'মাতৃছায়া'

বয়স্কদের আপন ঠিকানা 'মাতৃছায়া'

সন্তানরা খোঁজ পাবে, তাঁকে নিয়ে যাবে- অপেক্ষায় রোকে সর্দার তুলসি - সমকাল

মোস্তাফিজুর রহমান, ময়মনসিংহ

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪:১৮

'পথের বাপই বাপরে মনা, পথের মা-ই মা/ পথের বুকেই খুঁজে পাবি আপন ঠিকানা'- নগর বাউল জেমসের এই গান যে কারও বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধে। কিন্তু এসব মানুষ যদি হয় পড়ন্ত বয়সী; পথে বেরিয়ে ভুলে গেছেন ঠিকানা অথবা যাদের হাত ধরে পথ দেখিয়েছেন; তারা সংসারে অপাঙ্‌ক্তেয় ভেবে ফেলে গেছে; তা নিদারুণ যন্ত্রণার। এ জন্যই এখন বৃদ্ধাশ্রমের রমরমা ব্যবসা। তবে এখনও পথে এমন মানুষ অপেক্ষায় থাকেন, যাঁর স্পর্শ ভুলিয়ে দেয় ঘরের পিছুটান।

হাসপাতাল কিংবা রাস্তায় এমন অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পেলে নিজের কাছে এনে মা-বাবার মতো সেবা করেন ময়মনসিংহের নান্দাইলের মো. রফিকুল ইসলাম। এ জন্য তিনি জমি বিক্রি করে উপজেলার চরবেতাগৈর ইউনিয়নের চরকামটখালী গ্রামে গড়ে তুলেছেন 'মাতৃছায়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধ আশ্রয়কেন্দ্র'। অসহায় মানুষদের পরনের কাপড় আর দু'মুঠো খাবার জোগাড়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান।

২০১৮ সালে নিজের ৮ শতক জমিতে টিনশেড ঘরে আশ্রয়কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করেন রফিক। ৫ ফেব্রুয়ারি এখানে আধাপাকা ঘর করে দিয়েছে অ্যাপেক্স ক্লাব অব ময়মনসিংহ। আশ্রমের বাসিন্দাদের সেবা দিতে রফিক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চাকরি ছেড়েছেন সাত মাস আগে। হাসপাতালে এমএলএসএস পদে চাকরির সময় বৃদ্ধদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করেন। এখন কেন্দ্রে ১১ জন বাসিন্দা আছেন। রফিকের মানবিক এ উদ্যোগে স্ত্রী কল্পনা আক্তারও হাসিমুখে শ্রম দিচ্ছেন।

সরেজমিন আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা যায়, বসবাসরত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মা ও বাবা বলে ডাকছেন রফিক ও তাঁর স্ত্রী। কেন্দ্রের বারান্দায় বসে কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব ভানুমতীর সঙ্গে। ছয় মাস আগে তাঁকে কেন্দ্রে এনেছেন রফিক। তাঁর কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ অচল। ভানুমতী জানান, টাঙ্গাইলের মধুপুরে তাঁর বাড়ি। কৃষক স্বামী হযরত আলী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে দিনমজুর হবিবুরের সঙ্গে ছিলেন। একদিন বাসা থেকে বাজারের উদ্দেশে বের হওয়ার পর আর ফেরা হয়নি তাঁর।

রফিক জানান, ভানুমতীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এনেছেন তিনি। ভানুমতী অপেক্ষায় আছেন, সন্তানরা এসে তাঁকে নিয়ে যাবেন।

ষাটোর্ধ্ব মৃণাল কান্তিকে ২৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কেন্দ্রে আনা হয়। মৃণালের দাবি, তাঁর বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈর। তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে ঠাঁই হয়েছে। তিনিও আশায় আছেন, ছেলেমেয়ে জানতে পারলে নিয়ে যাবে।

আশ্রয়কেন্দ্রে তিন বছর আছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রোকে সর্দার তুলসী (৭৫); তিন বছর আগে ময়মনসিংহের চরপাড়া এলাকার রাস্তা থেকে মরিয়ম বেগম (৩৫); চার বছর আগে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগ বাজার থেকে অজ্ঞাতকে (৭০) আনা হলেও নাম দেওয়া হয়েছে ফুলবানু। অজ্ঞাত হিসেবে এসে চার বছর বসবাস করে নাম পেয়েছেন এলাচি বেগম (৬৬)।

কেন্দ্রের বাসিন্দা ময়মনসিংহ সদরের নতুনবাজার এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী বকুল বেগম (৭০) জানান, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সন্তানরা কেউ খোঁজ নেয় না। এ জন্য কেন্দ্রে আছেন। রফিকুল ইসলাম বলেন, 'রাস্তা ও হাসপাতালে দিনের পর দিন পড়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আমি কেন্দ্রে এনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকি। স্থানীয় ছাড়াও অনেক বিত্তবান সহায়তা করেন। ঘরে ঘরে গিয়ে পুরোনো কাপড়, চাল-ডাল চেয়ে আনি। আশ্রয়কেন্দ্র চালাতে ৩০ শতক জমিও বিক্রি করেছি।'

বীর বেতাগৈর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন সরকার বলেন, 'জমি বিক্রির টাকায় নিঃস্বার্থভাবে রফিকের অসহায় মানুষের পাশে থাকার মানবিক উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এ ধরনের কাজে সবার এগিয়ে আসা উচিত।' নান্দাইলের ইউএনও মোহাম্মদ আবুল মনসুর জানান, বৃদ্ধাশ্রমের জন্য বরাদ্দসাপেক্ষে চালসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। তবে সমাজের বিত্তশালীরা এগিয়ে এলে রফিকদের মতো মানুষের কাজ আরও সহজ হবে।

আরও পড়ুন

×