লোভের ফাঁদে আ'লীগ নেতা

হাসান হিমালয়, খুলনা
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ২২:৪৬
শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুলনার খোলাবাড়িয়া মৌজায় ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০২১ সালে। অধিগ্রহণের খবরে বিলের মধ্যে সেমিপাকা ঘর নির্মাণ শুরু করেন জমির মালিক আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আবেদ আলী। ইটের গাঁথুনি ও চালে টিন দিয়ে নির্মাণ করা হয় সারি সারি ঘর। কেউ যাতে আপত্তি না তোলে, সে জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এনে বিনা ভাড়ায় সেই ঘরে থাকতেও দেওয়া হয়। লাগানো হয় বিভিন্ন গাছের চারা।
তবে শেষ সময়ে এসে সিদ্ধান্ত বদল করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০০ নয়, ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এতে নতুন ঘরগুলো পড়েছে অধিগ্রহণ সীমানার বাইরে। বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে এখন দিশেহারা এই আওয়ামী লীগ নেতা।
শেখ আবেদ আলী নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। সদর থানা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে সিনিয়র সহসভাপতি করা হয় তাঁকে। তবে সেই কমিটির অনুমোদন মেলেনি।
খুলনা সিটি (রূপসা সেতু) বাইপাস সড়কের লবণচরা থানার পাশেই শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত জমি। বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের সামনের কিছু অংশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ছোট-বড় গাছ। প্রাচীরের শেষ প্রান্তে বিল। সেখানেই সারি সারি নতুন সেমিপাকা ঘর। কোনো ঘরেই নেই বিদ্যুৎ বা পানির সংযোগ।
প্রায় এক বছর আগে দুই ধাপে নির্মাণ করা বসতির এক লাইনে ১৮টি ও অন্য লাইনে আছে ৫টি ঘর। এ ছাড়া আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও কয়েকটি। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে কয়েকটি ঘরের জানালা খুলে গেছে। পলেস্তারাহীন একটি দেয়াল পরখ করে দেখা গেছে, নির্মাণে ব্যবহূত ইট অত্যন্ত নিম্নমানের। কিছুটা ভালো একটি ঘরে বাস করছেন মাসুমা আকতার। তিনি জানান, পাশের মোহাম্মদনগর এলাকার মক্কা সড়কে তিনি ভাড়া ছিলেন। জমির মালিক আবেদ আলীর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারেন, এখানে ফ্রি থাকা যাবে। ছয় মাস ধরে তিনি আছেন ওই ঘরে। মাসুমা আকতার বলেন, আগে ২ হাজার ২০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হতো। এখন এক টাকাও লাগে না। পাশের গরুর খামার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছেন। ক্ষেতের সাবমার্সিবল টিউবওয়েল থেকে পানি নেন। শুধু বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়।
পাশের ঘরে থাকেন রণজিতা বেগম। তিনি জানান, তাঁর স্বামী রাজমিস্ত্রি। ফ্রি থাকা যাচ্ছে জানতে পেরে তেরখাদা থেকে ডিসেম্বরে পরিবারসহ খুলনায় এসেছেন। এক মাস সেখানেই আছেন। ওই স্থানে এখন মোট ৭ পরিবারের বাস। বাকি ঘরগুলো অব্যবহূত। মাঝপথে বন্ধ রয়েছে অনেক ঘরের নির্মাণকাজ।
স্থানীয়রা জানান, আবেদ আলী এলাকায় আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত গুলজান সিটির জমিতে নতুন এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। অধিগ্রহণের আওতায় আনা বেশিরভাগ জমিই বিলান শ্রেণির। এ ধরনের জমির দাম কম। জমির শ্রেণি বদল করে বাস্তুভিটা করা এবং স্থাপনার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যই গত বছর ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল।
তবে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন শেখ আবেদ আলী। সমকালকে তিনি বলেন, ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ওই এলাকায় চীনের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। বছরের কিছু সময় শ্রমিকরা ঘরগুলো ভাড়া নেয়। তিনি দাবি করেন, অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের জন্য ওই ঘর নির্মাণ করা হয়নি।
বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগের তার চুরি হয়ে গেছে। নতুন করে তার কেনা হয়নি। আর পানির জন্য সেখানে সাবমার্সিবল টিউবওয়েল রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত জমির পাশে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না জিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেস ক্যাম্প। খুলনা নগরীতে ওয়াসার পয়ঃনিস্কাশন পাইপ স্থাপনের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। শেখ আবেদ আলীর নির্মাণ করা ঘরগুলোতে কোনো শ্রমিক ছিলেন কিনা জানতে চাইলে প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানান, সেখানে কখনোই তাঁদের শ্রমিক ভাড়া ছিলেন না।
এ এলাকায় রয়েছে আরও কয়েকটি আবাসন প্রকল্প। ওই প্রকল্পগুলোর সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যেই এক বছর আগে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়। প্রথমদিকে সেখানে আবেদ আলীর প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা থাকতেন। পরে তাঁরা চলে গেলে দীর্ঘদিন ফাঁকা ছিল। ছয় মাস ধরে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে ঘরে রাখা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আলোচনা ২০১৯ সালে শুরু হয়। ওই সময় থেকেই লবণচরা থানার পাশে ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিবসহ অনেক কর্মকর্তা ওই স্থান পরিদর্শনও করেন। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সভায় 'শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, খুলনা-২০২০' জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল উপাচার্য নিয়োগের পরই জমি চূড়ান্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
সূত্রটি জানায়, ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খোলাবাড়িয়া মৌজায় ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেন খুলনার জেলা প্রশাসক। সেভাবে কার্যক্রমও চলছিল। হঠাৎ গত ২৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি দেওয়া হয়। গত ৬ ডিসেম্বর ওই ৫০ একরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, 'আমাদের ১০০ একর জমিই প্রয়োজন ছিল। এখন কী কারণে মন্ত্রণালয় কেটে ৫০ একর করল, আমি জানি না। যেহেতু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছেন, তাই এখন আমাদের কিছু বলার নেই।'
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) মোছা. শাহানাজ পারভীন সমকালকে বলেন, 'প্রথমে আমরা ১০০ একরের কাগজপত্র পাঠিয়েছি। পরে মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ একরের কাগজপত্র এবং সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ মূল্য জানাতে বলে। আমরা সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ তৈরি করেছি। খুব শিগগিরই পাঠানো হবে।'