দাদনের মিথ্যা মামলায় তছনছ একটি পরিবার

সাজিদা ইসলাম পারুল, কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৬:২২
বহু কাঙ্ক্ষিত প্রথম সন্তান ঘরে এলেও সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি কিশোরগঞ্জের জেসমিন বেগম ও পায়েল মিয়া। এমনকি জন্মের পর থেকেই শিশুটি ঠান্ডাজনিত সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগলেও তাকে চিকিৎসক দেখাতে পারেননি চাতাল মিলের এই শ্রমিক দম্পতি। 'দাদন' নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। এখন পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখতে পাননি পায়েল মিয়া।
এমনকি জেসমিনের বাবা আব্দুল কাদির ও তাঁর বড় মেয়ে আকলিমা বেগম ওই মিথ্যা মামলায় ১৫ দিনের জেল খেটে বের হয়েছেন। পুলিশের তদন্তেই তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন। একটি পরিবারকে এভাবে তছনছ করার হোতা সর্দার কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার রফিকুল ইসলাম রবিউল। তিনি জোহরা-সুরুজ চাতাল মিলের শ্রমিক সর্দার। শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ করে সেটা জায়েজ করতেই তাঁদের নামে মামলা দিয়েছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনেরও অভিযোগ করেছেন অনেক নারী শ্রমিক। তবে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রামে জেসমিনের দেখা মেলে এই প্রতিবেদকের। কনকনে শীতে গ্রামের মানুষ তখন জবুথুবু হলেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে নির্ঘুম জেসমিন। কোলের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছেন।
পেটের ক্ষুধা মেটাতে রবিউলের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সোহাগপুর এলাকার জোহরা-সুরুজ চাতাল মিলে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন জেসমিন। কিন্তু সেখানে তাঁদের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। তিন-চার দিন পরপর দুই থেকে তিন কেজি চাল দিতেন রবিউল। ফলে কোনো দিন ডিম-দুধ বা ভালো খাবার জোটেনি। এমনকি স্বামীর অনুপস্থিতিতে জেসমিনকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করত রফিকুল। হুমকি দিত। পরে চাতাল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় জেসমিন। স্ত্রীর সন্ধান না পেয়ে পায়েলও চলে আসেন।
জেসমিন বলেন, 'জামাই ঘরে না থাকলে রফিকুল ঘরে ঢুইকা গায়ে হাত দিত। আর এসব কথা যাতে কাউকে না বলি, এজন্য হুমকিও দিতেন। এগুলান আমার আর সহ্য অইতো না। তাই বাধ্য হইয়া পালাইছি।' ক্ষোভ প্রকাশ করে জেসমিন বলেন, 'আমি তাঁর থেকে কোনো টাকা নেই নাই। উল্টো আমার পারিশ্রমিকও দিত না রফিকুল। টাকা চাইলেই বলত বছর শেষে হিসাব কইরা দিব। এত কিছু করার পরেও মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার বাবা ও বোনকে জেল খাটিয়েছে। আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে। নিজের সন্তানের চিকিৎসাও করাইতে পারতাছি না। পেটের সেলাইও কাটতে পারি নাই। আমি এ থেকে মুক্তি এবং রফিকুলের বিচার চাই।'
জেসমিন ও পায়েলের পথ ধরে যৌন হয়রানির শিকার আরও এক নারী শ্রমিকও পালিয়ে আসেন। এর পরই রফিকুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বুধবার ওই চাতালে গেলে আরও অনেক নারী রফিকুলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। শেষে রফিকুলও চাতাল মালিকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। রফিকুলকে চরিত্রহীন ও লম্পট দাবি করে তাঁর কঠিন শাস্তি দাবি করেন এখানকার নারী শ্রমিকরা।
চাতালে কর্মরত ষাটোর্ধ্ব শ্রমিক রুমা বেগম সমকালকে বলেন, 'রফিকুল চাতালে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সঙ্গে সব সময়ই খারাপ আচরণ করত। এমনকি বিভিন্ন সময় আমার ঘরের মধ্যেও প্রবেশ করত, গায়ে হাত দিত। জেসমিনের ঘরেও প্রবেশ করে তার সঙ্গে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করত। আমরা এর প্রতিবাদ করলে অকথ্য ভাষায় গালি দিত।'
চাতালের ম্যানেজার মামুন খান বলেন, জেসমিনের বাবা আব্দুল কাদির ও বোন আকলিমা কখনও এই চাতালের শ্রমিক ছিলেন না। তিনি বলেন, রফিকুল একজন চরিত্রহীন। তিনি বর্তমানে পলাতক। রফিকুল এখানের আগের ম্যানেজারের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
তবে রফিকুল দাবি করেন, পালিয়ে যাওয়া আটজন পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। জেসমিনের বাবা ও বড় বোন এখানে অল্প কয়েক দিন কাজ করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। চাতাল মালিকের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে তিনি নিজেও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার কোনো প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কাজে শ্রমিক জয়েন করলেই আমরা দাদনের টাকা দিয়ে দেই। কোনো লিখিত থাকে না। শুধু আমাদের খাতায় কখন কত টাকা দেওয়া হয়, তা লেখা থাকে। এতে শ্রমিকদের কোনো স্বাক্ষর কিংবা টিপসই থাকে না।' যৌন হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, 'এসব কথা মিথ্যা।'
মামলা প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) ডেপুটি ম্যানেজার (আইন) অ্যাডভোকেট এ কে এম বুলবুল আহমেদ বলেন, 'রফিকুলের মামলার শক্ত কোনো ভিত্তি নেই।
- বিষয় :
- দাদন
- মিথ্যা মামলা
- কিশোরগঞ্জ
- যৌন নির্যাতন