কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে এবার শুরু হয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা এসব চাঁদাবাজি করছে। আশ্রয় শিবিরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাঝি ও সাব-মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) এবং আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে থাকা দোকান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে তারা। জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদাবাজির এ টাকা দিতে কেউ অপারগতা প্রকাশ করলে চালানো হয় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। এমনকি অপহরণ কিংবা খুনের ঘটনাও ঘটছে। আরসাকে চাঁদা না দেওয়ায় ক্যাম্প-২-ই-এর মাঝি আবুল কালাম ও নুরুল আলমকে হত্যা করা হয়েছে।
ক্যাম্প-২-এর মাঝি মোহাম্মদ আমিন সমকালকে জানান, আরসার সন্ত্রাসীরা আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদের সেই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এবার যোগ হয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি। গত এক মাস ধরে তারা ক্যাম্পে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি করছে। জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে এ বিষয়ে কেউ কথাও বলছে না।
এ রোহিঙ্গা নেতা বলেন, তার কাছ থেকে গত এক মাসে কয়েক দফায় ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে আরসার সন্ত্রাসীরা। জীবনের নিরাপত্তার কারণে এ চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানানো হয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম, মৌলভি জাবের, হাফেজ ইউনুস, মৌলভি হামজা, ছমিউদ্দিন, হাফেজ সালমান মোহাম্মদ শফিক, নুর মোহাম্মদ, মাহমুদুর রহমানসহ অন্তত শতাধিক সন্ত্রাসী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আশ্রয়শিবিরে চাঁদাবাজি করছে।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায় ১৮শ মাঝি ও সাব-মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) রয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক হাজার দোকান রয়েছে। মূলত তাদের কাছ থেকে এ চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
আরসা সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক সৈয়দ হারুন অর রশিদ সমকালকে বলেন, মুলত চাঁদাবাজির কারণে আশ্রয়শিবিরে গোলাগুলি, অপহরণ ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এসব সন্ত্রাসীকে ধরতে আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান নিয়মিত চলছে। অনেকে ধরাও পড়ছে। কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হোতাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। হোতাদের অনেকে আশ্রয়শিবিরের বাইরে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা নেতারা জানান, গত মার্চে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এ ছাড়া অন্তত ৫০ জন রোহিঙ্গাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত রোববার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের ক্যাম্প-৮-এ সৈয়দ আলম নামের এক রোহিঙ্গাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে বিকেল ৪টার আগেই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়েন রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা। বিকেল ৫টার পর পুলিশের তেমন টহলও দেখা যায় না। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর পুরো এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩১টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২০টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, আশ্রয়শিবিরে চাঁদাবাজি করছে বলে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ৮-১০টি করে মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজন এজাহারভুক্ত আসামি ধরা পড়লেও মূল হোতাদের এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি। হোতাদের অনেকে মিয়ানমারের পাহাড়ে আত্মগোপন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে জমা দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের ২ হাজার ৩০০ সদস্য নিয়োজিত আছেন।