জমিতে পানি না পেয়ে বিষপান
কৃষক মুকুলের কাছে টাকা চেয়েছিলেন অপারেটর বাবু

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাঁওতাল কৃষক মুকুল সারেন- সমকাল
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩ | ১৩:৫৫ | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৩ | ১৪:৩৫
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে মুকুল সরেন (৩৫) নামে এক সাঁওতাল কৃষক বিষপান করেন। অভিযোগ উঠেছে, ধানের জমিতে সেচের পানির জন্য তিনি নলকূপ অপারেটর হাসেম আলী বাবুর কাছে যান। পাইপ মেরামতের জন্য বাবু তখন মুকুলের কাছে বিঘাপ্রতি ৮০ টাকা চাঁদা চান। মুকুল সরেনের কাছে টাকা না থাকায় তিনি বাবুকে অনুরোধ করে বলেন, ‘এখন টাকা নেই, পরে দেব।’ কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। গত রোববার দুপুরে তিনি আবার পানির জন্য যান। এ সময় সেচের পানি না পেয়ে ক্ষোভে বিষপান করেন মুকুল সরেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কৃষক মুকুল সরেন সমকালকে বলেন, ‘বিষ খাবার পর বাবু আমার জমিতে পানি দিয়েছে শুনেছি। আমরা আদিবাসী লোক। আমার কিছু করার নেই, তাই বিষ খেয়ে নিয়েছি।’
গোদাগাড়ীর ঈশ্বরীপুর-২ গভীর নলকূপ অপারেটর হাসেম আলী বাবু বলেন, ‘মুকুল ও মুকুলের চাচা মোংলা সরেন গত ১৬ ও ১৭ মার্চ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পানি চায়। নেশাগ্রস্ত কেউ পানি চাইলে না দেওয়ার ব্যাপারে পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে বলা রয়েছে। তাই তাকে পানি দেইনি। এই ক্ষোভে মুকুল ও তার চাচা ৩০০ ফুট পানির পাইপ ফুটো করে দিয়েছিল। এটা মেরামতের জন্য ২৫ হাজার টাকা লেগেছে। এই টাকা বিএমডিএ দেবে না। তাই সব কৃষকের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি ৮০ টাকা করে নিয়ে এই খরচ তোলা হয়। মুকুল সরেন টাকা দেয়নি। তবুও আমি তাকে পানি দিতে চেয়েছি। সিরিয়ালে রেখেছি তাকে। তবে মুকুল আমাকে জেল খাটাবে বলে হুমকি দেয়। তখন বিষ খেতে বোতল নেয়। আমি বোতল কেড়ে নিই। এরপর বাড়ি গিয়ে কী খেয়েছে তা জানিনা।’
ঈশ্বরীপুর-২ গভীর নলকূপের পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘নেশা করে পানি নিতে এলে খারাপ কথাবার্তা বলে। এ জন্য পানি নিতে কেউ যেন নেশা করে না আসে, সেটা বলা ছিল।’ তিনি বলেন, ‘পাইপ মেরামতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা লাগত। বিঘাপ্রতি হয়তো ২০ টাকা লাগত। আমরা অপারেটরের কাছে হিসাব চেয়েছিলাম। আগামী শুক্রবার হিসাব দেওয়ার কথা। তার আগেই এ ঘটনা ঘটেছে।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুকুলের পাশেই ছিলেন তার মা দুলি হেমব্রম ও দুলাভাই রবি কিসকু। দুলি হেমব্রম জানান, অপারেটর বাবু প্রায়ই তাঁদের ধানের জমিতে পানি দিত না। মুকুল সারাদিন মানুষের জমিতে কাজ করে। ফিরে এসে আবার অপারেটর বাবুর পেছনে ঘোরে পানির জন্য। পানির জন্যই মুকুল বিষপান করে।
দুলাভাই রবি কিসকু বলেন, ওই গভীর নলকূপে আড়াইশ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তবে সেচ দেয় ৪০০ বিঘা জমিতে। এ কারণে প্রায়ই পানির সংকট হয়।
এদিকে কেউ কেউ বলছেন, স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে আত্মহননের চেষ্টা চালিয়েছেন গোদাগাড়ীর দেউপাড়া ইউনিয়নের বর্ষপাড়া গ্রামের বাসিন্দা গোপাল সরেনের ছেলে মুকুল সরেন।
এ ঘটনায় গোদাগাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্চয় মোহন্তকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রশীদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। এ ছাড়া আমার মোবাইল নম্বর সবাইকে দিয়ে দেব। পানির জন্য কাউকে মরতে দেব না। পানির ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে আমাকে সবাই সরাসরি জানাতে পারবেন।’
তদন্ত কমিটির প্রধান সঞ্চয় মোহন্ত বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পানির সংকট পাইনি। গভীর নলকূপ অপারেটর বাবুর সম্পর্কে কেউ খারাপ কথাও বলেনি। মুকুলের জমিতে পানি আছে। তাঁর বাবাও বলেছেন, পানির সংকট নেই। মুকুল সরেনের স্ত্রী ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা রেখে চলে গেছে। এ জন্য তিনি হতাশায় রয়েছেন। পাইপ ভাঙার জন্য বিঘাপ্রতি ৮০ টাকা চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি কেউ আমাদের জানায়নি।’
বিএমডিএর চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহান বলেন, ‘বিএমডিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পানির সংকট পায়নি। মুকুল সরেনের অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি। তাঁর জমিতে পানি আছে। মুকুলের স্ত্রী সন্তানদের রেখে চলে গেছে। সে নেশাগ্রস্ত ছিল। হতাশাগ্রস্ত হয়ে সে বিষপান করে।’ অপারেটর বাবু কেন চাঁদা চেয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ বলেনি।’
গোদাগাড়ীর দেউপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ‘মুকুল সরেন ভালো আছে। হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। ঘটনাস্থলেও কোনো সমস্যা নেই। মুকুলের জমিতে পানি আছে।’ তিনি আরও বলেন, “মুকুল আমার কাছে দুই মাস আগে একবার এসে বলে, ‘গভীর নলকূপের পানি পাচ্ছি না।’ তখন অপারেটর বাবুকে বকেছিলাম। পরে আর কোনো অভিযোগ পাইনি।”
- বিষয় :
- রাজশাহী
- গোদাগাড়ী
- কৃষকের বিষপান