‘ভাঙন রোধ করতে না পারলে ভাইসা যাওয়াই ভালো’

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন। ছবি-সমকাল
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩ | ১৬:০১ | আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৩ | ১৬:০১
‘৯ শতক জমিতে বসতবাড়ি ছিল। গত বছরের বানের সময় বাড়ির অর্ধেক ভিটা ভাইঙা যায়। এর পর বাকি জায়গায় ঘর তুইল্যা আছিলাম। এবারও নদীতে পানি বেশি হওয়ায় কয়দিন আগে সবটুকু ভাইঙা গেছেগা। এহন (এখন) পাশে (ব্রহ্মপুত্র পাড়ে) মানুষের জমিতে কোনো রহম ছাপড়া ঘর তুইল্যা আছি। হে (সে) ঘরও কহন ভাইঙা যাবো গা, তা নিয়া চিন্তায় থাকি। ব্রহ্মপুত্র আমগোরে সব কাইরা নিল। পোলার বাপের কাজকাম নাই। দুই পোলারে ঠিক মতন খাওন দিতে পারি না। অনেক কষ্টে থাকি।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রৌমারী উপজেলার চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী এলাকার গোলে বানু।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে চরশৌলমারী বাজার থেকে ২ কিলোমিটার দূরে ঘুঘুমারীর ভাঙন এলাকায় যেতেই চোখে পড়ে দিনমজুর জাবেদ আলীর ঝুপড়ি ঘর। দেখা যায়, একটু সামনেই শুরু হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন। ভাঙনের শিকার হয়ে রাস্তার ধারে পাটখড়ির বেড়ায় ভাঙাচোরা টিনের ছোট্ট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করছেন জাবেদ আলী। তাঁর ভাষ্য, এক মাসের মধ্যে বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রে। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। খুব কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
জাবেদ আলীর মেয়ে জেসমিন আক্তার জানান, চার বছর ধরে তাঁর স্বামী জেলহাজতে থাকায় ঠাঁই নিয়েছিলেন বৃদ্ধ বাবার বাড়ি। সেটিও ব্রহ্মপুত্রে বিলীন।
একটু দূরেই ফেরিওয়ালা সবুর আলীর বাড়ি। ২০ দিন আগে ব্রহ্মপুত্রে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়িও শেষ। অন্যের জমিতে ঠাঁই নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে সব ভাইঙা গেছে। গ্রাম-গঞ্জে ফেরি কইরা কোনোমতে সংসার চলে। হেইডাও বন্ধ হয়ে গেছে। কী করুম, না করুম– বুঝবার পারতাছি না।’
সাত দিন আগে সুফিয়া খাতুনের বসতভিটার অর্ধেক ভেঙে গেছে ব্রহ্মপুত্রে। তিনি বলেন, ‘আমগোরে কোনোখানে যাওনের জায়গা নাই। তাই এই খানেই থাকি। রাইতে ঘুম হয় না। দুই ম্যায়ারে (মেয়ে) নিয়া ভয়ে থাকি।’
১০ বছর আগে ছেড়ে চলে যান ফিরোজা খাতুনের স্বামী। পরে ঠাঁই নেন বাবার বাড়িতে। এই বাড়ি সাত দিন আগে বিলীন হয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রে। আক্ষেপ করে ফিরোজা বলেন, ‘ভাঙন রোধ করতে না পারলে, নদীতে ভাইসা (ভেসে) যাওয়াই ভালো।’
এক মাস আগে ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়েছে দুলুফা খাতুনের বসতভিটা। অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। তাঁর দাবি, স্বামী ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে সংসারের খরচ জোগান। পানি বাড়ায় কয়েক দিন ধরে তাঁর কাজকর্ম বন্ধ। দুই সন্তান নিয়ে কষ্টে রয়েছেন তারা।
বছর দুয়েক আগে ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে গেছে ঘুঘুমারী এলাকার একমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক। এর পর থেকে ঘুঘুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেবা দেন ক্লিনিক কর্মী মামুন হাসান। তাঁর ভাষ্য, এক ব্যক্তি ক্লিনিকের জন্য জমি দান করলেও করা হয়নি কোনো ভবন।
কথা হয় চরশৌলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এইচ এম সাইদুর রহমান দুলালের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, গত এক মাসে ঘুঘুমারী গ্রামের ৪০টি বসতভিটা, আবাদি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে সুখেরবাতি, চর সোনাপুর, চর গোন্দার আলাগা ও হবিগঞ্জ এলাকা। এতে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েকশ পরিবার।
গত চার বছরে ঘুঘুমারী গ্রামের ৪০০ বসতভিটা নদে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের একাধিকবার ভাঙনের বিষয়টি জানালেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ চেয়ারম্যান দুলালের।
রৌমারী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেশকাতুর রহমানের দাবি, ৪০টি পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চালসহ নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত শুক্রবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ ঘুঘুমারী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। অনুমতি পেলে কাজ করা হবে। তাঁর ভাষ্য, ভাঙন শুরু হয়েছে ৩২ কিলোমিটার জায়গায়। আর কাজ শুরু করা হয়েছে মাত্র ৬ কিলোমিটার জায়গায়। তবে জরুরি কাজের জন্য কোনো বরাদ্দ থাকে না। অনুমতি সাপেক্ষে করতে হয়।
- বিষয় :
- ব্রহ্মপুত্র
- নদী ভাঙন