ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

মিরসরাই ট্র্যাজেডি

ভেজা চোখে সকাল দেখেন দুখিনী মায়েরা

ভেজা চোখে সকাল দেখেন দুখিনী মায়েরা

মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত সন্তানের ছবি হাতে কাঁদছেন এক মা - সমকাল

জয়নাল আবেদীন, ঢাকা বিপুল দাশ, মিরসরাই

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:০৭

গণিতের বইটি খোলা রেখেই খেলার মাঠে ছুটে গিয়েছিল তাকিব মাহমুদ সাকিব। যে খেলার টানে অঙ্কের ইতি না টেনেই বের হয়ে যায় সাকিব, সেটাই তার জীবনের ইতি টেনে দেয়।

২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে যায় সাকিবের প্রাণপ্রদীপ। এরপর কেটে গেছে আট বছরের বেশি সময়। খোলা বই, পাটিগণিতের অসমাপ্ত অঙ্কের পৃষ্ঠা আর ক্লিপ-খোলা কলমটি আজও পড়ে আছে সাকিবের টেবিলে। পরম মমতায় সাকিবের  স্কুলড্রেস, জুতা আর শিক্ষাসামগ্রী আগলে রেখেছেন তার দুখিনী মা পারভীন আক্তার। চোখ বুঁজলেই এসবে বুকের ধনকে খুঁজে পান তিনি। এতে যে জড়িয়ে আছে সাকিবের স্পর্শ!

সাকিবের মতোই সেদিন নিমেষে হারিয়ে গিয়েছিল আরও ৪৩ শিশু-কিশোর।

এখনও বিকেল হলে মনের খেয়ালে দুয়ার খুলে বসে থাকেন পারুল আক্তার। উঠানের সামনের বাঁকা পথ ধরে এই বুঝি ঘরে ফিরছে প্রিয় সন্তান রাহাত মাহমুদ। রাহাত যাওয়ার সময় বলেছিল- 'মা, তুমি একদম দেরি করবে না, তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করো। আমি ফিরলে একসঙ্গে খাব।' ছেলেটা আর কোনোদিন এমন কথা বলেনি। তবে সেদিন কেন বলেছিল? কত প্রশ্ন ঢেউ তোলে মায়ের মনে! রান্নাটা মা ঠিকই তাড়াতাড়ি শেষ করেছিলেন, শুধু ছেলেটাই আর ফিরল না। সেই থেকে খেতে বসলেই রাহাতের ছবি ভেসে ওঠে পারুলের ঝাপসা চোখে।

রাকিব মাকে বলেছিল, 'জান দিয়ে দেব, তবু খেলা ছাড়তে পারব না।' মা ছেলের মাথায় তেল মেখে দেন। স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। রাকিব মায়ের কাছে জানতে চায়, 'বলো তো মা, আজ কারা জিতবে?' মায়ের কৌশলী উত্তর ছিল, 'কারা আবার, যারা ভালো খেলবে তারাই জিতবে।' সাইফুলের দল কিন্তু ঠিকই জিতেছিল। কিন্তু সে হেরে যায় নিয়তির কাছে।

সাকিব, রাহাত, রাকিবেরা খেলাপাগল বলে নানা ছুতোয় মায়ের মন গলানোর চেষ্টা করেছিল। তবে ধ্রুব নাথ ছিল ব্যতিক্রম। সে ছিল পড়ার পাগল। তাই তাকে নিয়ে মায়ের কোনো ভয়ই ছিল না। তবুও ঘর থেকে বেরোনোর সময় সেদিন মাকে সে বলেছিল, 'ভালো ছেলেরা কখনও পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না। ওরা সবাই গেলেও আমি খেলায় যাব না। আমি স্কুলে যাব।' কিন্তু বন্ধুত্বের কাছে হার মেনে ধ্রুব খেলায় গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে-ও হারিয়ে যায় মহাকালের তিমিরে। মেধাবী ধ্রুবর হাতের লেখা, জামাকাপড় আলমারিতে অতি যত্নে গুছিয়ে রেখেছেন মা।

মিরসরাইয়ের মায়ানী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে রচিত সেই শোকগাথা আজও বয়ে বেড়ান মায়েরা। বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে মিরসরাই সদরের স্টেডিয়াম মাঠ থেকে ফেরার পথে আবুতোরাব-বড়তাকিয়া সড়কের দক্ষিণ সৈদালী গ্রামে ডোবায় উল্টে যায় শিক্ষার্থীবাহী মিনিট্রাক।

স্টিয়ারিং হাতে বসেছিলেন চালকবেশী 'হেলপার'। ট্রাকের পিঠে তুলেছিলেন ৭০ থেকে ৮০ শিশু-কিশোর। আর তাদের নিয়েই রাস্তার পাশে কাদাজলে মুখ থুবড়ে পড়ে মিনিট্রাকটি। জয়োল্লাস থেমে মুহূর্তেই বেজে ওঠে বেদনার করুণ রোদন। ডোবার সামান্য পানিতে 'লোহার খাঁচা'র আকার ধরে ট্রাকটি। সেই খাঁচায় বন্দি প্রাণের ব্যাকুলতা চেপে যায় নিঃশব্দের মৃত্যুকূপে। চিরতরে থেমে যায় কিশোর দলের প্রাণোচ্ছল দুরন্তপনা।

সেদিন ভিসুভিয়াসের লাভার নিচে ধ্বংস হয়ে যায় ছয় গ্রামের একটি প্রজন্ম। সেই দিনটি ইতিহাসের কালো কাচে বন্দি হয়ে আছে আজও। বলা হয়, 'পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ।' সেদিন এমন ৪৩টি বোঝা উঠেছিল পিতার কাঁধে, মামার কাঁধে, চাচার কাঁধে। কিংবা বহু কষ্টে হিমালয়ের মতো ভারী সেই বোঝা বইছিলেন কারও প্রিয় দাদু, কারও বড় ভাই।

আবুতোরাবের সেই শোকগাথা স্মৃতির মিনারে আজও তাজা ইতিহাস। ছোট ছোট নিষ্পাপ জীবন নিয়ে উপুড় হয়ে ডোবায় আটকে থাকা মিনিট্রাক, সুজনের মায়ের বুক চাপড়ানো আর্তনাদ, বাবার অন্তহীন অশ্রুপাত- ছয়টি গ্রামে শোকের আয়নায় প্রতিফলিত হয় নিত্যদিন। এই বোবাকান্না হয়তো আজও ছুঁয়ে যায় মিরসরাইয়ের সীমানা ছাড়িয়ে আরও কোটি হৃদয়ে।

নিরাপদ সড়ক চান মায়েরা :নিহত ধ্রুব নাথের মা আবুতোরাব ভূঁইয়া কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষিকা সুপ্রীতি নাথ বলেন, মিরসরাই ট্র্যাজেডি এড়াতে দরকার দক্ষ চালকের হাতে গাড়ি দেওয়া, ট্রাফিক আইন মানতে চালক, যাত্রী ও পথচারীদের বাধ্য করা।

সৈদালী এলাকার দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গজ এগিয়ে গেলে নিহত আবুতোরাব মাদ্রাসার ছাত্র সাহেদুল হোসেনের বাড়ি। সাহেদুলের শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সাহেদুলের বড় ভাই ফারুক হোসেন। একে একে দুই সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারানোর শোকে পাথর মা জাহানারা বেগম। কোথাও সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনলে আঁতকে ওঠেন জাহানারা। জাহানারা তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র বেঁচে থাকা আকবর হোসেনকে আঁকড়ে ধরে ভুলে থাকতে চান হারানো সন্তানদের কথা। জাহানারা বেগম বলেন, দুর্ঘটনায় তার যা গেছে, তা যেন আর কারও না যায়। আল্লাহর কাছে তিনি এ কামনাই করেন।

আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল কাজল নাথ। তার মধ্যম মায়ানী গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা অনিতা নাথ সন্তানের পড়ার বই-খাতাগুলো এখনও সাজিয়ে রেখেছেন টেবিলে। স্কুলড্রেসটিও রেখেছেন যত্ন করে। নিহত কাজল নাথের কথা তুলতেই অনিতা নাথের দুই চোখ অশ্রুতে ভিজে যায়। তিনি বলেন, তার তিন সন্তানের মধ্যে কাজল মেজ ছিল। তার ব্যবহূত বই-খাতা আট বছর ধরে পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখেন তিনি। তিনি বলেন, চালকরা সচেতন হলেই দেশে অনেক দুর্ঘটনা কমে যাবে।

প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের নিহত ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদের দুর্ঘটনার সময় পরনে থাকা জামা-প্যান্ট, তার খেলার সামগ্রী অনেক যত্নে আলমারিতে তুলে রেখেছেন মা রোকেয়া খাতুন। ছেলের কথা তুলতেই তিনি বলেন, আর কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত করার দাবি করেন তিনি। আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার বলেন, সেদিন তার প্রতিষ্ঠানের ৩৫ ছাত্র নিহত হয়েছিল। অদক্ষ চালকের কারণেই ঘটে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনা।

আরও পড়ুন

×