এতদিনে জীবনে বাজল আনন্দের সুর

কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গায় ১৯টি ঢুলি পরিবার এখন পাকা বাড়ির মালিক। ঘর পেয়ে মনের আনন্দে বুধবার বাদ্য বাজান অনিল চন্দ্র বিশ্বাসসহ অন্যরা - সমকাল
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৩ | ০০:০৬
‘৫০ বছরের বেশি সময় ধরি ঢোল বাজাই। কোন জাগাত অনুষ্ঠান হইলে ডাক পড়ে। যেদিন না হয় সেদিন বসি দিন কাটে। যা কামাই (আয়) হয় তা দিয়া সংসার কোনোমতে চলে। পাকা বাড়ি হামার করা দূর থাউক, ভাববেরে পাইনে। শেখের বেটি আইজ বাড়ি দেইল হামাক, এটা স্বপ্ন নাগবেইছে (মনে হচ্ছে)।’
কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গার বাসিন্দা অনিল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি একজন বাদ্যকর। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পূজা-পার্বণে যারা ঢাকঢোল, সানাই, ঝুনঝুনি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অন্যকে আনন্দ দেন, তাদের জীবনেই দিন শেষে ছিল বিষাদের ছায়া। জীর্ণ-শীর্ণ কুঁড়েঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় কাটত তাদের দিন।
অনিল চন্দ্রের মতো ঢুলিপাড়ার আরও ১৯টি পরিবারের গল্প যেন একই সুতোয় গাঁথা। প্রায় অর্ধশতক ধরে ঢাকের তালে নিজে দোলেন ও অন্যকে দোলান বাদ্যকররা। তাদের বাবা বাজিয়েছেন, বাবার বাবা কিংবা দাদার দাদাও করেছেন একই কাজ। বংশপরম্পরায় বাদ্য বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন যারা, তাদের কাছে একটু ভালোভাবে বসবাস করা যেন রূপকথার গল্পের মতো।
দীর্ঘদিনের হতাশা আর বঞ্চনার কষ্ট অবশেষে দূর হলো ১৯টি ঢুলি পরিবারের। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প ২-এর আওতায় পাকা বাড়ি পেয়েছেন তারা। তাদের চোখমুখে তাই আনন্দের ঝিলিক। বাড়ি পেয়ে বিশেষ পূজা-অর্চনার মাধ্যমে এ সম্প্রদায়ের নারীরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ঈশ্বরকে। নেচে-গেয়ে এ আনন্দকে তারা সবাই মিলে উপভোগ করছেন।
পাকা বাড়ি পাওয়া অমল বিশ্বাস বলেন, ‘হামরাগুল্যা (আমরা) যাই মাইনষের অনুষ্ঠানে বাজনা বাজাতে। তখন বাড়িঘর সোগ ছাড়ি যাওয়া নাগে। দুই-চার দিন থাকা হয়। কিন্তু অন্যকে আনন্দ দিলেও চিন্তায় থাকতাম। বাড়ির মানুষগুল্যা ঠিকঠাক আছে নাকি! কী করিল, কী খাইল। এল্যা (এখন) আর সেই দিন থাকপের নয়। নতুন বাড়ি হামার জীবন বদলে দিছে। এল্যা যতুটুক কামাই করমো না কেন, তা নিয়্যা অন্তত শান্তিত ঘুমবের পামো। হামার কষ্ট হামার প্রধানমন্ত্রী দেখছে। তাক ধন্যবাদ।’
আরেক বাসিন্দা সান্ত্বনা রানী বলেন, সরকার তাদের পাকা ঘরের সঙ্গে একটি পাকা মন্দির করে দিয়েছে। তাদের গ্রামের মন্দিরটা টিনের তৈরি ও ভাঙা ছিল। পাকা মন্দিরে সবাই একসঙ্গে পূজা দিতে পারবেন– এতে সত্যি খুব আনন্দ লাগছে তাঁর।
ঢুলিপাড়ার পাশের গ্রামের কলেজছাত্র শিফাত রহমান বলেন, বাড়ির অভিভাবকরা যখন বাইরে কাজে চলে যেতেন, তখন জীর্ণ-শীর্ণ ঘরে নারীরা ভয়ে ভয়ে রাত পার করতেন। কিন্তু পাকা বাড়িতে এখন আর সেই কষ্ট হবে না তাদের। শিশুরা পাশের স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে– এটি সত্যি আনন্দের।
রাজারহাটের ইউএনও নূরে তাসনিম বলেন, এটি একটি ইউনিক প্রকল্প। কারণ এ জনগোষ্ঠীর যারা মানুষকে আনন্দ দেয়, মানুষের বিভিন্ন উৎসব আয়োজনকে সরব করে, দিন শেষে তাদের থাকার জায়গাটি ছিল জরাজীর্ণ। অন্যের জায়গায় আশ্রিত হিসেবে থাকতেন এই সম্প্রদায়ের লোকজন। তাদের এই দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন পান, সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে প্রকল্পটি ডিজাইন করা হয়।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা সবসময় সরকারের রয়েছে। এরই আলোকে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প ২-এর অধীনে ঘড়িয়ালডাঙার এই ১৯টি ঢুলি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে পাকা বাড়ি। তাদের হয়েছে স্থায়ী ঠিকানা।
- বিষয় :
- প্রধানমন্ত্রীর উপহার
- উপহারের ঘর