ভোলায় আতঙ্কের দিনলিপি

::ফাইল ছবি
নাসির লিটন, ভোলা
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:১৫ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:২৯
ফেসবুকে একটি বিতর্কিত পোস্টকে কেন্দ্র করে রোববার ভোলার বোরহানউদ্দিনে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় 'তৌহিদী জনতা'র সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল সোমবার পুরো জেলায় ছিল থমথমে অবস্থা। সাধারণ মানুষের আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় কেটেছে দিন। এদিন অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অভ্যন্তরীণ রুটে যান চলাচল বন্ধ ছিল। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে নবগঠিত 'সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ' তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। তবে আন্দোলনকারীরা ভোলা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। জেলা সদরের কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভ মিছিলও করতে দেখা গেছে। সংঘর্ষে নিহত চারজনের লাশ গতকাল পরিবারের কাছে হস্তান্তর ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে রোববারে সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বোরহানউদ্দিন থানায় অজ্ঞাত ৪-৫ হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে। অপরদিকে ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দেওয়ার ঘটনায় আটক বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য, ইমন ও শরীফ ওরফে শাকিলকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজির নেতৃত্বে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত টিম এবং বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত টিম কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকেই জেলা শহরের প্রবেশমুখ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। বাইরে মানুষের খুব একটা আনাগোনা দেখা যায়নি। পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় পুলিশের পাশাপাশি চার প্লাটুন বিজিবি, এক প্লাটুন কোস্টগার্ড, শতাধিক র্যাব সদস্য ও বরিশাল থেকে অতিরিক্ত দুই শতাধিক পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়। জেলায় সব ধরনের মিছিল ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক।
'সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ'-এর পূর্বঘোষিত সমাবেশস্থল ভোলা সরকারি স্কুুল মাঠ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিদারুল আলম, পিয়াস চন্দ্র ও সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে। ফলে নবগঠিত এ সংগঠনের কেউ স্কুল মাঠে প্রবেশ করতে পারেনি। পরে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের একটি অংশ বেলা ১১টার দিকে ভোলা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যে ওইখানে বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। সেখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ঘিরে রাখে। পরে ভোলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের আহ্বায়ক মাওলানা বশির উদ্দিন ও সদস্য সচিব মাওলানা তাজ উদ্দিন ফারুকী স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা মিজানুর রহমান।
এ সময় তারা ৬ দফা দাবিসহ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- ভোলার পুলিশ সুপার ও বোরহানউদ্দিন থানার ওসিকে প্রত্যাহার; তদন্ত করে গুলির হুকুমদাতা ও গুলিবর্ষণকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া; মহানবীকে (সা.) নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করা; কটূক্তিকারী বিপ্লবের ফাঁসি; সংঘর্ষে নিহত চারজনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এসব দাবি পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা না এলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- নবগঠিত সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র অন্দোলন, এবতেহাদুল ওলামাইন মাদারাছিন কওমিয়া, ভোলা, জমিয়তুল মোদাররেছিন, ইমান আকিদা কমিটিসহ কয়েকটি সমমনা সংগঠন রয়েছে।
ভোলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু রয়েছে উল্লেখ করে বরিশালের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেছেন, 'সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ যেসব দাবি করেছে, সেগুলোর আইনি বিষয় খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে পুলিশের সংশ্নিষ্ট দপ্তর কাজ করছে। আর ফেসবুক হ্যাকিংটি টেকনিক্যাল ব্যাপার। এ জন্য ঢাকায় পুলিশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।' জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ: ভোলার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার বাইরে সমকালের ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবদেক ও জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা। 'তৌহিদী জনতা'র ব্যানারে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠন এসব বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ মোড়ে অবস্থান নিয়ে বেলা ২টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন। এতে ব্যস্ততম এ সড়কে মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার হল চত্বর ও বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয়। উভয় মিছিলেই চরমোনাই পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ছিল। বিকেলে অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশে মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তিকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করাসহ ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সামনে থেকে দুপুর ১২টায় একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোবারক উল্লাহর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন সাজেদুর রহমান, মুফতি আব্দুর রহিম কাসেমী, মাওলানা ইউসুফ প্রমুখ। নেত্রকোনা জেলা শহরের বারহাট্টা রোডের মিফতাহুল উলুম মাদ্রাসার হেফাজত চত্বর থেকে মিছিল বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে সমাবেশ হয়। এতে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। বেলা ২টায় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে স্থানীয় মার্কাজ মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ইত্তেফাকুল উলামা। পরে উপজেলা পরিষদে গিয়ে সমাবেশ হয়।
বিকেলে শহরের ডিআইটি জামে মসজিদ এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশে নারায়ণগঞ্জ জেলা ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবদুল আউয়াল বলেন, 'নবীর বিরুদ্ধে কটূক্তি হবে আর তৌহিদী জনতা ঘরে বসে থাকবে, সেটা হয় না। যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাতে হবে।' আরও বক্তব্য দেন জেলা হেফাজতে ইসলামের সমন্বয়কারী ফেরদাউসুর রহমান, খেলাফত মজলিশের সভাপতি সিরাজুল মামুন, মহানগরের সভাপতি ডা. মোসাদ্দেক, হেফাজত নেতা আবদুল কাদির, মহানগর ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, মাওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজি, হারুন অর রশিদ, কামালউদ্দিন দায়েমী প্রমুখ।
- বিষয় :
- ভোলায় আতঙ্ক
- ভোলা