‘মোরা মরলে ঘরে বাতি দিত কে’

মঠবাড়িয়ার হোগলাপাতির বাড়িতে মা ও ছেলেদের সঙ্গে খলিল ফকির সমকাল
ফসিউল ইসলাম বাচ্চু, পিরোজপুর ও মিজানুর রহমান মিজু, মঠবাড়িয়া
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
বঙ্গোপসাগরে তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে ছিল মাছ ধরার একটি ট্রলার। উত্তাল সাগরের বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন মাঝিমাল্লা। বারবার বন্ধ করে দিতে হয় ইঞ্জিন। এভাবে তিন দিন-তিন রাত দিশা হারিয়ে একবার বাংলাদেশ, আরেকবার ভারতের জলসীমায় আসা-যাওয়া করতে হয়। সর্বশেষ দিন মবিলের পাইপ ফেটে বন্ধ হয়ে যায় ইঞ্জিন। অবশেষে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কর্মীরা ওই ৯ জেলেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
সোমবার প্রবল বর্ষণের মধ্যে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌর এলাকার ১৮ কিলোমিটার দূরে খলিলের বসতবাড়িতে কথা হয় সমকালের। খানিক দূরেই হোগলপাতি বাজার। বেড়িবাঁধের পরই বলেশ্বর। খলিলের ‘মায়ের দোয়া’ ট্রলারটি বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয় ২৮ জুলাই। এতে খলিল ছাড়াও ছিলেন তাঁর তিন ছেলে মানিক ফকির (২৭), হেলাল ফকির (২২) ও দুলাল ফকির (২০); একই গ্রামের জয়নাল হোসেনের ছেলে আলাউদ্দিন (২৬), সোনা মিয়ার ছেলে খলিল হোসেন (৪২), উলুবাড়িয়া গ্রামের কাদের বিশ্বাসের ছেলে শহিদুল বিশ্বাস (৩৫) এবং বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউদখালী গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে আবু সাইয়েদ (৫৫) ও রায়েন্দা গ্রামের কাদের হাওলাদারের ছেলে জিয়া (৪৪)।
খলিল ফকির বলছিলেন, মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা শেষে রওনা হন লম্বায় ৩৪ ফুট ও ১৩ ফুট চওড়া ট্রলারে করে। আড়াই লাখ টাকা ধারদেনায় এটি তৈরি করেন তিনি। সঙ্গে ছিল ইলিশ ধরার চার লাখ টাকার জাল। সেদিন সন্ধ্যায় বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানী বাজারে যান। সেখান থেকে বাজার করে রাত্রিযাপন করেন। শনিবার ভোর রাতে যাত্রা শুরু হয়। ১০-১২ ঘণ্টা চলার পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গভীর সাগরের ১০ নম্বর বয়ার (শিব শ্যারাইন) কাছে জাল ফেলেন। পরদিন রোববারও মাছ ধরেন। সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেল ৩টার দিকে জাল ফেলার পর অপেক্ষা করছিলেন জাল টানার। তখন পর্যন্ত মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল পরিস্থিতি।
বিরূপ পরিস্থিতি দেখা দেয় রাত ১০টার দিকে জাল টানার সময়। মাছ ট্রলারে ওঠানোর পরপরই পূর্ব-উত্তর দিক থেকে প্রবল বেগে ঝড় শুরু হয়। এতে ট্রলারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন মাঝিরা। তীব্র বাতাসের সঙ্গে প্রবল স্রোত ও উত্তাল ঢেউয়ের কারণে ট্রলারের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে ৩০ ফুট জাল সাগরে ফেলে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন।
এভাবে চলে ১০-১২ ঘণ্টা। সাগরে ভাসতে ভাসতে ১০ নম্বর বয়া পেরিয়ে ভারতের সমুদ্রসীমায় চলে যায় ট্রলারটি। ঝড় চলার মধ্যেই সোমবার শেষরাতে পানির গভীরতা পরিমাপ করতে পারেননি তারা। আবারও ছয়-সাত ঘণ্টা ট্রলার চালানো শুরু করেন। মঙ্গলবার (১ আগস্ট) তারা দেখেন, আবারও ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়েছেন। এদিন গভীর রাতে ট্রলারের নোঙর (গেরাফি) ছিঁড়ে যায়।
এ সময় খলিল ছেলেদের কাছে জীবন নিয়ে শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। বলেন, ‘তোরা সবাই আল্লাহ-বিল্লাহ কর।’ রাতে মোনাজাত করেন, ‘হে আল্লাহ আমার কোনোকিছুর দরকার নাই। আমাগো জান কয়ডা ভিক্ষা দেও।’ এর মধ্যে রাতদিন পেরিয়ে গেলেও কিছু মুখে দেননি কেউ। এ সময় তিনি ছদকা হিসেবে ছাগল, পবিত্র কোরআন শরিফ ও মাজারের বাক্সে টাকা মানত করেন।
মঙ্গলবার গভীর রাতে আবারও ইঞ্জিন চালু করেন খলিল। ছয়-সাত ঘণ্টা চালানোর পর বুধবার সকাল ৮-৯টার দিকে ফেটে যায় ইঞ্জিনের মবিল পাইপ। এতে মবিল পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায় ইঞ্জিন। এ সময় সাগরের চারপাশে শুধু ধোঁয়া দেখছিলেন। হতাশার গভীরতা বাড়াচ্ছিল আশপাশে নৌযানের অনুপস্থিতি।
ভারতীয় একটি জাহাজ তাদের দেখতে পেলেও আটক করেনি, হয়তো বিপদে পড়েছেন– বুঝতে পেরেছিল তারা। বুধবার দুপুরে নিয়ন্ত্রণহারা ট্রলারটি ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের সীমানায় ঢোকে। সাতক্ষীরা বন বিভাগের মান্দাবাড়িয়া অভয়ারণ্য কেন্দ্রের টহল দল তাদের উদ্ধার করে। এ সময় ৯ মাঝিমাল্লা আনন্দে কেঁদে ফেলেন। ট্রলারটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বন বিভাগের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানেই রান্না করে খাওয়ানো হয় জেলেদের। খলিল ফকির বলেন, ট্রলার মেরামত করে শুক্রবার (৪ আগস্ট) রাতে তাদের ছেড়ে দেন বন বিভাগের কর্মীরা। ধারদেনা করে জ্বালানি তেল কেনেন। পরে চালনা ও মোংলা হয়ে ১৯ ঘণ্টা পর শনিবার রাতে বাড়ি ফেরেন।
কেঁদে কেঁদে খলিলুর রহমান ফকির বলেন, ‘ঝড়ে যদি মোরা বাপ-বেটারা মইরা যাইতাম, তা হইলে পোতায় (ঘরে) বাতি দেয়ার কেউ আলহে (থাকতো) না। মায় বুড়া অইয়া গেছে, রোগা মানুষ– যে কোনো সময় মইরা যাইত। আর বউ, স্বামী-সন্তান হারানোর শোকে শেষ অইয়া যাইত।’ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসায় স্বস্তি প্রকাশ করছিলেন। তবে ঋণের চিন্তার পাশাপাশি নতুন দুশ্চিন্তা ভর করেছে। পাউবোর বাঁধ থেকে উচ্ছেদের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাদের।
সাগরে আবারও মাছ ধরতে যাবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে খলিল বলেন, চরদোয়ানীর আড়তদার নাসির ও পাড়েরহাটের শাহজান মুন্সির কাছে ছয় লাখ টাকা দেনা আছে। এলাকায় আরও চার লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। এই ১০ লাখ টাকা ঋণ শোধের মতো কোনো সম্পত্তি নেই। তাই মারা গেলেও সন্তানদের সেই ঋণ শোধ করতে হবে। অতএব আবারও মাছ ধরতে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।
পাশ থেকে খলিলের বৃদ্ধ মা খাদিজা বেগম (৭২) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এই কয়দিন মুই গাং (নদী) পাড়ে গেছি আর আইছি। রাইতে ঘুমাই নাই। আল্লায় মোর পোলারে ফিরাইয়া দেছে।’ এ নারীর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। এদের মধ্যে দুই ছেলে শৈশবেই হারিয়ে যায়। কোথায় আছে তারা জানেন না। অল্প বয়সে স্বামী হারানোর পর খলিলের ওপর নির্ভরশীল পুরোপুরি। যেখানে থাকেন– সেখান থেকে ঘর সরানোর নোটিশ পেয়েছেন। এ নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
হোগলপাতি গ্রামটি পড়েছে উপজেলার আমড়াগাছি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় ইউপি সদস্য সেলিম খান বলেন, ছেলেদের নিয়ে জেলে খলিলের নিখোঁজ হওয়ার খবরে সবাই মর্মাহত হন। তারা ফেরার পর বাড়িতে গেছেন সান্ত্বনা দিতে। তিনি শুনেছেন, অনেক ধারদেনা করে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তারা। সাধ্যমতো সহায়তায় আশ্বাস দেন।