সর্বনাশের মূলে ভাঙা বেড়িবাঁধ আর রেললাইনের ‘ছোট সেতু’

পহরচাঁদার মুন্সিঘোনা এলাকায় বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, শুক্রবার বিকেলেও পাশের বিলে জমে আছে বন্যার পানি - সমকাল
নাসির উদ্দিন হায়দার, চকরিয়া থেকে ফিরে
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩ | ০৫:৪৭ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৩ | ০৭:১২
চকরিয়া উপজেলার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন বরইতলী ইউনিয়নের একতাবাজার এলাকা। এলাকাটি ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিতি। চট্টগ্রাম শহরে যত ফুল বিক্রি হয় এর বড় একটি অংশ আসে এই গ্রাম থেকে। বরইতলী থেকে পেকুয়া পর্যন্ত চার লেনের বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সংযোগ সড়কটি এলাকার যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। সড়কের দুই পাশে বিশাল হারবাং বিল। বিলে থৈ থৈ পানি। হারবাং বিলে আগাম সবজি চাষের জন্য যে আউশ ধান রোপণ করা হয়ছিল, সেসব এখনও বন্যার পানির নিচে। সেই পানিতে মাছ ধরছেন শত শত মানুষ।
সড়কের পাশে মাছ ধরা দেখছিলেন মছনিয়াকাটা গ্রামের আহমদ কবির। কিছুক্ষণ পরপর বানের পানিতে ডুবে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই হায় হায় করে উঠলেন– বললেন, প্রতি বছর তিনি এক একর জমিতে আগাম টমেটো, চিচিঙ্গা ও মরিচ ক্ষেত করেন। গত জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ধানের চারা রোপণ করেছিলেন, ভাদ্র মাসে ধান কাটার পর সবজি ক্ষেত করার আশা ছিল, এখন আর কোনো আশা নেই– সব আশা ভাসিয়ে নিয়েছে বন্যার জল।
হারবাং বিলে পহরচাঁদা, হারবাং ও ডেইঙ্গাকাটা– এ তিন গ্রামের মানুষ ধান ও সবজি চাষ করেন। মছনিয়াকাটা থেকে শুরু পহরচাঁদা গ্রামের সীমানা। কিছুটা পাহাড়ি এলাকা পার হলে পড়ে পহরচাঁদা ফাজিল সিনিয়র মাদ্রাসা, সেখানে সুন্দর ইউলুপ তৈরি করা হয়েছে; পশ্চিমে চলে গেছে পেকুয়া সড়ক, দক্ষিণে কুতুব বাজার ও রাবার ড্যাম যাওয়ার সড়ক। সড়কের সঙ্গে লাগানো বারবাকিয়া খাল। ‘ফাঁসের গুদাম’ নামক এলাকা পার হয়ে কিছুদূর গেলে মাতামুহুরী নদী। মাতামুহরী তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে পহরচাঁদাকে। এই গ্রাম চকরিয়ার সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকা। গ্রামের চারদিকে বেড়িবাঁধ আছে কিন্তু মুন্সিঘোনায় প্রায় ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ ভাঙা। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে মাতামুহরীর জোয়ারের পানি, ঢুকে পড়ে বন্যার পানিও। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই বেড়িবাঁধ মেরামত না করে ফেলে রেখেছে বছরের পর বছর। মুন্সিঘোনা রাবার ড্যামে যেতে হয় যে সড়ক দিয়ে সেটি আসলে বেড়িবাঁধ। গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ সেখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে কুঁড়েঘর নির্মাণ করে বসত করে আসছেন। বেড়িবাধ দিয়ে যাওয়ার সময় একের পর এক ভাঙা ঘর চোখে পড়ে। কোন ঘরের চাল নেই, নেই বেড়া, আবার কোন ঘরের একটি কোণ হা করে আছে। এর কারণ কি জিঙ্গেস করলে স্থানীয় সমাজকর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদু রহিম সিকদার বললেন, এবার বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পানি। পানির তোড়ে প্রায় বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পিচঢালা বেড়িবাঁধ উপড়ে নিয়ে গেছে।
এবার গোটা চকরিয়ায় বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি হলো পহরচাঁদা। গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা চারদিন পানিতে ডুবে ছিল এই গ্রাম। এবার ঘরের চাল ছুঁয়েছে পানি। অনেকে ডুব দিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন। এই গ্রামে কোন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তাই অসংখ্য মানুষ রেললাইনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এবার বন্যা এত ভয়াবহ হওয়ার কারণ সম্পর্কে পহরচাঁদা ফাজিল সিনিয়ন মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ অবু সাঈদ আনছারী বললেন, কুরইল্যা লুট কাটিংয়ের কারণে মাতামুহুরী নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে, পাশপাশি রাবার ড্যামের কারণেও নদী ভরাট হয়ে গেছে। এতে লোকালয় ভয়াবহভাবে প্লাবিত হচ্ছে। আবার গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। রেললাইনে বড় সেতু দেওয়া হয়নি। ছোট সেতু দিয়ে ধীরে পানি নেমেছে। ফলে এবার লোকালয় প্রায় চারদিন পানিতে ডুবে ছিল।
পহরচাঁদা কুতুব বাজারের চিকিৎসক ডা. মাঈনুদ্দিন বললেন, অতীতে কখনো বাজারে পানি উঠেনি। এবার বাজারে নৌকা চলেছে। অর্ধশত দোকানের চাল-সিমেন্টসহ দামি পণ্য ভিজে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় অর্ধকোটি টাকবা হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এবার প্রথমে উজান দিয়ে অর্থাৎ পশ্চিমে মুন্সিঘোনায় খোলা বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রথম পহরচাঁদা গ্রামে পানি ঢুকেছে। এরপর আজিমুদ্দিন সিকদার পাড়ার পূর্ব ও পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গেছে। দুই দিকের পানি ফুলেফেঁপে উঠে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কুতুব বাজারের উত্তরে মূলত পাহাড়ি এলাকা। কিন্তু এবার পাহাড়ের পাদদেশে থাকা বাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে।
পহরচাঁদা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা মোজাহের আহমেদ বললেন, বন্যার পানিতে ঘরের কিছুই বাচাতে পারেননি। ধান-চাল, বেড-বিছানা থেকে শুরু করে সবকিছুই নষ্ট হয়েছে। আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘হিসাব করে দেখলাম প্রায় দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার পরিবারে।’
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার চারদিন পরও এলাকাবাসী সরকারি কোন সহায়তা পাননি। তবে কালামিয়া সর্দার বাড়ির গিয়াস উদ্দিন ও তার পরিবারের সদস্যদের চেষ্টায় গত শুক্রবার চট্টগ্রামের একটি শিল্পগ্রুপ প্রায় ৩০০ পরিবারে চাল দিয়েছে বলে দুর্গতরা জানান।
- বিষয় :
- বন্যা
- চকরিয়া
- চকরিয়া বন্যা