জঙ্গিবাদে ফাহিম, বিশ্বাস হচ্ছে না মা-বাবার

প্রতীকী ছবি
যশোর অফিস
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩ | ০৩:৫০
ঢাকার নটর ডেম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ফাহিম খান (১৮)। পড়াশোনার সুবাদে থাকত কলেজ হোস্টেলে। ঈদুল আজহার দু’দিন আগে ছুটিতে যশোরের বাড়ি যায়। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে গত ২৮ জুলাই বাড়ি ছাড়ে। পরে পরিবার অনেক সন্ধান করেও ফাহিমকে পায়নি।
১২ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এ সময় ছয় নারীসহ যে ১৭ জন আটক হয়, তাদের মধ্যে ফাহিম রয়েছে। সিটিটিসির দাবি, ফাহিম নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য। তবে তার জঙ্গিবাদে জড়ানোর হিসাব মেলাতে পারছে না পরিবার। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারাও মেধাবী ছেলেটির এমন কর্মকাণ্ডে জড়ানোর খবরে হতবাক।
ফাহিমের বাড়ি যশোর শহরের বারান্দী মোল্লাপাড়া আমতলায়। তার অ্যাডভোকেট বাবা আইয়ুব খান বাবুল আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য ও যশোর আদালতের এপিপি। দুই স্ত্রীর পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে ফাহিম সবার বড়।
ফাহিমের সৎমা আসফাকুন্নাহার বলেন, নার্সারিতে পড়ার সময় ফাহিমের মা মারা যান। এরপর সংসারে এসে কখনও তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি। ঈদে বাড়ি এসে ২৮ জুলাই সকালে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি থেকে বের হয়। দুপুরে খেতে না এলে ফোন করে মোবাইল বন্ধ পাই। এরপর স্বজন, বন্ধুসহ সম্ভাব্য সবখানে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পর দিন ওর বাবা জিডি করে। হঠাৎ গত শনিবার টেলিভিশনের সংবাদে মৌলভীবাজার থেকে আটক কিশোর-যুবকদের ছবি ও নাম-পরিচয় দেখে ফাহিমকে শনাক্ত করা হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ফাহিম যশোর বোর্ডে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগের মেধাতালিকায় নবম স্থান অধিকার করে। পরে তাকে ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি করি। অসুস্থতার কারণে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেনি। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান এইচএসসির ফরম পূরণ করতে দেয়নি। এ জন্য সে হতাশায় ভেঙে পড়ে এবং ঘরে একা থাকত। তবে আমাদের চোখে তার মধ্যে জঙ্গিবাদের কিছু পড়েনি।
ঢাকার সিএমএম আদালতে বৃহস্পতিবার ছেলেকে তোলা হবে জেনে সেখানে যান আইয়ুব খান বাবুল। তিনি বলেন, ছোট থেকেই ফাহিমের মনের ভেতরে মায়ের মৃত্যুর যন্ত্রণা ছিল। নানা রোগেও ভুগছিল। বাসায় থাকলে মোবাইল ফোন নিয়ে থাকত, আড্ডাবাজি কিংবা দলাদলিতে ছিল না। জঙ্গিবাদে জড়ানোর মতো কিছু চোখে পড়েনি। সন্দেহজনক কারও সঙ্গে চলতেও দেখিনি। সহজ-সরল ছেলের জঙ্গিবাদে জড়ানোর হিসাব মেলাতে পারছি না; বিশ্বাসও হচ্ছে না। কেউ হয়তো ফাঁসানোর জন্য এমনটি করেছে বলে মনে করছেন সরকারি এ কৌঁসুলি। বৃহস্পতিবার আমতলার বাড়ি গিয়ে সুনসান নীরবতা পাওয়া যায়। বিমর্ষ পরিবারের সদস্যরা। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বের হচ্ছেন না। নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ আসছেনও না। প্রতিবেশীরা জানান, বাবার মতোই এলাকায় ফাহিমের মেধাবী ছাত্র হিসেবে সুনাম রয়েছে। সে বেশির ভাগ সময় বাড়ি ও কয়েক বাড়ি পরে নানাবাড়িতে সময় কাটত তার। আগে সেভাবে ধর্ম পালন না করলেও সম্প্রতি দাড়ি রাখে এবং নামাজ পড়া শুরু করে।
প্রতিবেশী মঞ্জুর আহমেদ বাবু ও নাজনীন নাহার কল্পনা জানান, ফাহিমরা দুই ভাই। ওরা যখন খুব ছোট, বাবা আরেক বিয়ে করেন। এটি মেনে নিতে না পেরে তাদের মা আত্মহত্যা করেন। সৎমায়ের ঘরে আরও দুই বোন রয়েছে। কিন্তু সৎমা নিয়ে সংসারে কোনো ঝামেলা নেই। ফাহিম এ পথে যাবে, তাদেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। মা-হারা নাতি পুলিশের কাছে জেনে ষাটোর্ধ্ব হাসিয়া বেগমও কাতর।’
যশোর ডিবির উপপরিদর্শক মফিজুল ইসলাম জানান, বাবা জিডি করলে ফাহিমের মোবাইল ট্র্যাকিং করে পাবনার একটি বাসে যশোর ছাড়ার তথ্য পাওয়া যায়। পরিবার ও স্বজনরা গত ৫-৬ মাস তার গতিবিধিতে পরিবর্তন পান। এ সময়ে দাড়ি রাখে, বাসায় একা একা থাকত। মোবাইলে ভাই ভাই বলে কথা বলত। এসব বিশেষ লক্ষণে ফাহিম ধর্মীয় কোনো সংগঠনে জড়িত হয়ে আত্মগোপনে রয়েছে ধারণা করে বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানায়। পরে সিটিটিসি তদন্ত করে ফাহিমের সূত্র ধরেই পাবনা ও কুলাউড়ায় অভিযান চালিয়ে দু’দফায় ফাহিমসহ ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করে।
- বিষয় :
- ফাহিম খান
- জঙ্গিবাদ
- ইমাম মাহমুদের কাফেলা