খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি
জনপ্রতিনিধি-কর্মকর্তা মিলে কার্ড বাণিজ্য

৪৫০ জন স্লিপ নিয়ে ডিলারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন
সিংড়া (নাটোর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ২০:১৪
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনিয়ম ও অর্থ বাণিজ্য হচ্ছে নাটোরের সিংড়ার রামানন্দ খাজুরায়। এই ইউনিয়নে অসহায়-দরিদ্রদের মাঝে ১৫ টাকা কেজির চাল বিতরণের জন্য কার্ডপ্রতি নেওয়া হয়েছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে। প্রকৃত উপকারভোগীদের বাদ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভুয়া তালিকা। এতে উপকারভোগীরা বঞ্চিত হলেও নিয়মিত খাদ্যপণ্য পাচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান, মেম্বার ও উদ্যোক্তা মিলে এ কারবার চালালেও দায় নিচ্ছেন না কেউ। উল্টো একে অপরের বিরুদ্ধে কার্ড বাণিজ্যের অভিযোগ তুলছেন।
জানা গেছে, উপজেলার রামানন্দ খাজুরায় ৯টি ওয়ার্ডে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালের উপকারভোগী ১ হাজার ৫৫৫ জন। তাদের নাম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও আছে। কিন্তু চাল বিতরণের জন্য অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে ডিলারদের কাছে যে তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে ১২১ জনের নামের পাশে ‘ক্রস’ চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। প্রিন্ট করার পর কলম দিয়ে সেই কাটা চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, তারা চাল পাবেন না। এর বিপরীতে একটি অতিরিক্ত তালিকা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে অন্য ১২১ জনের নাম আছে। তাদের চাল দেওয়ার জন্য ডিলারদের নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা। এ তথ্য ডিলাররাই দিয়েছেন। আবার টাকার বিনিময়ে ৪৫০ জনকে একটি করে স্লিপ দেওয়া হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। তাদের বলা হয়েছে, ওই স্লিপ দেখালেই ডিলাররা চাল দেবেন। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। এই ৪৫০ জন স্লিপ নিয়ে ডিলারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কোনো ফায়দা হচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার সকালে ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কৈগ্রাম বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কার্ড হাতে ডিলারের দোকানের সামনে ঘোরঘুরি করছিলেন উপকারভোগীরা। ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৫০৮ জন সুবিধাভোগীদের মাঝে চাল বিতরণ করছেন ডিলার শ্যামল কুমার সরকার। ভোক্তাদের ছবিসহ তালিকায় নাম থাকলেও চাল পাচ্ছেন না। ডিলারকে প্রশ্ন করতেই বললেন, উপজেল খাদ্য অফিস থেকে সরবরাহ করা তালিকায় ওই ব্যক্তিদের নামের পাশে ক্রস চিহ্ন দেওয়া আছে। এমন কার্ডধারী আছেন ৩৪ জন। তাদের বিপরীতে অন্য ৩৪টি নাম দেওয়া হয়েছে। তাদের চাল দিতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুস ছালাম বিশ্বাস নির্দেশ দিয়েছেন।
১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার আবদুর রশিদের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, খাদ্য অফিস থেকে ৫০৮ জনের ডিও উত্তোলন করলেও বিতরণ বন্ধ। কারণ হিসেবে ডিলার বলেন, আমার সুবিধামতো সময় চাল বিক্রয় করব।
ইউনিয়নের বসন্তপুর ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার গোপেন চন্দ্র প্রামাণিকের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দুই মাসের ৬০ কেজি চালের পরিবর্তে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হচ্ছিল। সেখানেও তালিকার অনেককেই চাল দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত দরিদ্র ভোক্তা চাল নিতে এসে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। সেখানে চাল বিতরণে ছবিসহ ৫৩৯ জনের প্রিন্ট করা তালিকার পাশাপাশি আরও ৫৪ জনের অতিরিক্ত তালিকা অনুযায়ী চাল দিচ্ছেন ডিলার।
লাইনে কার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আশরাফুল বলেন, ‘অনলাইন তালিকায় আমার নাম থাকলেও ক্রস চিহ্ন থাকায় চাল দিচ্ছে না। কিন্তু চাল না পেলে আমার পরিবার যে অভুক্ত থাকবে।’ শিউলি বেগম বলেন, দানেশ মেম্বার টাকা নিয়ে কার্ড করে দিয়েছেন। কিন্তু ডিলার চাল দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।
চাল না পাওয়া অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, নতুন চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার পর থেকেই এ সমস্যা হচ্ছে। তারা নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের চাল দিলেও প্রকৃত উপকারভোগীদের দেওয়া হচ্ছে না। ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মিলন হোসেন ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য দানেশ আলী ২ থেকে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে অনেককে এই কার্ড করে দিয়েছেন। তাছাড়া যারা টাকা দিতে পারেননি, এখন তাদের নাম থাকলেও চাল পাচ্ছেন না।
মিলন ও দানেশ মেম্বার বলেন, এলাকায় আমাদের বিরোধী একটা পক্ষ আছে। তারা আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে টাকা নেওয়ার অভিযোগ করছেন।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা আবদুল কাদের বলেন, অতিরিক্ত কার্ডগুলো করা হয়েছে চেয়ারম্যানের নির্দেশে। আমি শুধু নির্দেশ বাস্তবায়ন করি। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। তালিকা করার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান আর তা অনুমোদন দেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক।
চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, আমি কারও নাম কাটা বা তালিকা সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিছু কার্ড ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা আবদুল কাদের এবং খাদ্য কর্মকর্তা যোগসাজশে তৈরি করে দিয়েছেন। এ কারণে চাল বিতরণে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা আবদুস ছালাম বিশ্বাস বলেন, ১ হাজার ৫৫৫ জনের বাইরে কারও তালিকা আমি দিইনি। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আমি অনলাইনের তালিকা প্রিন্ট করে দিয়েছি। এর বাইরে কারও কাছে চাল বিক্রির সুযোগ নেই। আর কোনো উদ্যোক্তার সঙ্গে যোগসাজশের প্রশ্নই আসে না।
ইউএনও মাহমুদা খাতুন বলেন, চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। খোঁজখবর নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে।