‘বান আইসে বান যায় হামার কষ্ট কাই দেখপে?’

বন্যার পানিতে ডুবে আছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু। দুই শিশুসহ নৌকায় গন্তব্যে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের উলিপুরের এক নারী। শনিবারের ছবি - সমকাল
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩:২৮
‘পেটের দায়ে গরুগুলা বর্গা নিছি। দুইটা বাছুর হইছে। বড় করে সামনের কোরবানির হাটে বেচমো। বাড়ি-ঘর সোগ ছাড়ি চলি গেইলে এগলারে দেখপে (দেখবে) কাই (কে)? বান আইসে বান যায়, হামার কষ্ট কাই দেখপে?’
আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের খেয়ার আলগা চরের বাসিন্দা বৃদ্ধ এনছান আলী। এ বছরে দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরিবারসহ নিজ বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু আগস্টে তৃতীয় দফা বন্যায় আর ঝুঁকি নিতে পারেননি। সন্তান ও পুত্রবধূকে পাঠিয়ে দিয়েছেন শহরে আত্মীয়ের বাসায়। গরুগুলোকে কে দেখবে, তা ভেবে বাড়ি ছাড়তে পারেননি তিনি। এক বেলা ভাত, আরেক বেলা শুকনো খাবারে চলছে এনছান আলী ও তাঁর স্ত্রী শরবানু বেগমের বানভাসি জীবন।
শনিবার দেখা যায়, পানি একটু কমার কারণে গোয়ালঘরের উঁচু ভিটায় দুপুরের রান্না বসিয়েছেন শরবানু বেগম। সরকারের দেওয়া ১০ কেজি চাল পেয়েছিলেন বুধবার। সেই চালের ভাতের সঙ্গে বেগুনের ঝোল খাবেন তারা। শরবানু বলেন, ‘বাড়ির চারপাকে কত পানি, তাও হামার পানির কষ্ট। বানের পানি ফুটি খাওয়া নাগে (লাগে), কলের খাওয়ার পানির খুব কষ্ট হইছে। এত দিন নৌকাত কষ্ট করি ভাত রান্না করা নাগছে। আজ (শনিবার) উঁচু ভিটাত রান্না করলোং (করলাম)।’
পার্শ্ববর্তী চর ইয়ুথনেটে ছোট্ট একটি দোকান রয়েছে মাসুদ রানার। বন্যার কারণে পাঁচ দিন দোকান বন্ধ ছিল। এতে ব্যবসায় ভাটা পড়ে। পানি কমে যাওয়ায় গতকাল দোকান খোলেন মাসুদ। কিন্তু দোকানের সামনে এখনও কোমরপানি থাকায় বিপাকে চরের এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘ছয়-সাতটা দিন মা-বাবাকে নিয়ে নৌকার মধ্যে কষ্ট করে ছিলাম। শুক্রবার থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি কমছে। তবে সরকারিভাবে সহায়তা পাইনি।’
কুড়িগ্রামের পাঁচ উপজেলার প্রায় সাত হাজার পরিবারের অবস্থা এনছান আলী ও মাসুদ রানার মতোই। ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সব নদনদীর পানি কমলেও বাড়িঘর থেকে এখনও পুরোপুরি নামেনি বানের পানি। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বানভাসিরা। জেলা প্রশাসন থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য বলছেন তারা।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার তথ্যমতে, কুড়িগ্রামে তৃতীয় ধাপের বন্যায় ৫ হাজার ২৮০টি পরিবারের ২০ হাজার ১৩৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে ৬৫৭টি, নষ্ট হয়েছে ৫ হাজার ৬৮৩ হেক্টর আবাদি জমি। চরাঞ্চলের ২৮ দশমিক ৩৬ বর্গকিলোমিটার এখনও ডুবে আছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারের পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, চাহিদা অনুযায়ী বানভাসি পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে পাহাড়ি ঢলে ও ভারী বর্ষণে গাইবান্ধায় নদনদীর পানি বাড়ছে। গতকাল বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতীরবর্তী নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলে পানি উঠেছে। এসব এলাকার ফসলি জমি এবং নিচু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শহীদুজ্জামান জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ৭ হাজার ২০টি পরিবার পানিবন্দি। গাইবান্ধা পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মজিবর রহমান জানান, পানি বাড়ায় কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুন্দরগঞ্জ, সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ৭৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই চার উপজেলায় ৫০ হাজার
টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলার জন্য বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ৫০টি শুকনো খাবার প্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ
দপ্তর জানিয়েছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি]