এক ঘা নাকি দুই ঘা, জেলি না তালশাঁস

তানজীম আহমেদ, বাগেরহাট
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিরিঞ্জের মাধ্যমে চিংড়িতে নানারকম অপদ্রব্য প্রয়োগ করে ওজন বাড়ান। ফলে একদিকে নষ্ট হচ্ছে দেশের চিংড়ির সুনাম, তেমনি কমছে রপ্তানি। লোকসানে পড়ছেন শিল্প সংশ্লিষ্ট সবাই। চিংড়িতে প্রয়োগ করা এসব অপদ্রব্য মানবদেহে ক্ষতির পাশাপাশি বিপর্যস্ত করে তুলছে এই শিল্পের অস্তিত্বও।
বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর এলাকায় চিংড়িতে সবচেয়ে বেশি অপদ্রব্য প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। চাষিরা এ কাজে যুক্ত হতে না চাওয়ায় কৌশল বদলে অসাধু ব্যবসায়ীরা অপদ্রব্য প্রয়োগের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রামের বিভিন্ন বাড়িকে। এরপর জেলি মিশ্রিত চিংড়ি রেখে দেওয়া হয় রাস্তার পাশে। সেখান থেকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায়। এ ছাড়া রামপাল উপজেলার ফয়লা, মোংলার কয়েকটি এলাকা, সদর উপজেলার বারাকপুর, সিঅ্যান্ডবি, মোল্লাহাটের মাদ্রাসাঘাটসহ বিভিন্ন অঞ্চলেও অপদ্রব্য প্রয়োগের ঘটনা ঘটে।
কৌশল হিসেবে অসাধু ব্যবসায়ীরা সড়কের প্রবেশ মুখে তথ্যদাতা রাখেন। তথ্যদাতার কাজ রাস্তায় বসে থাকা এবং প্রশাসন বা অপরিচিত কাউকে এলাকায় ঢুকতে দেখলে ফোনে খবর দেওয়া। এতে প্রয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে যায় এবং সব গুটিয়ে দ্রুত পালায়।
এ কাজে যুক্ত কয়েকজন জানান, চিংড়ির ওজন বাড়াতে এর ভেতরে সাধারণত জেলি বা আগার, পেরেক, সাবুদানা, ময়দা, ফিটকিরির পানি, গুনা তার, ভাতের মাড়, রাসায়নিক মিশ্রিত পানি, অ্যারারুট, অ্যালোভেরার শাঁস, সিসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল ঢোকানো হয়। জেলির চেয়েও ভারি যেসব পদার্থ ঢোকানো হয় সাংকেতিকভাবে এর নাম তালশাঁস। সাধারণত আগার পাউডার গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে জেলি তৈরি করা হয়। হালকা গরম থাকা অবস্থায় চিংড়ির মাথায় এবং লেজে সিরিঞ্জের মাধ্যমে এই জেলি ঢুকিয়ে রাখা হয় ঠান্ডা পানিতে। পরে জেলি লিচুর মতো আঠালো হয়ে চিংড়ির সঙ্গে মিশে যায়। নতুন করে চিংড়ি এলে অপদ্রব্য প্রয়োগে জড়িতরা ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করে, এক ঘা নাকি দুই ঘা, জেলি নাকি তালশাঁস? অর্থাৎ এর মাধ্যমে তারা কোন পদার্থ কতটুকু ঢোকানো হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
ফকিরহাটের মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার বলেন, এখান থেকে চিংড়ি নিয়ে চরকুলিয়া, নাশুয়াখালী, রূপসা, জয়ঢেহি, মাদ্রাসাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় অপদ্রব্য প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। সাধারণ চাষিরা কখনোই চিংড়িতে অপদ্রব্য প্রয়োগ করেন না। এটা করে মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালরা। তারা এই চিংড়ি বিক্রি করে কোম্পানির কাছে। যদি কোম্পানিগুলো অপদ্রব্য প্রয়োগ করা চিংড়ি কেনা বন্ধ করে, তাহলে এই তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল চিংড়ি শিল্প রক্ষার্থে চাষি-ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জেলি মিশ্রিত চিংড়ি চেনার উপায় সাদা হওয়ায় চিংড়ির শরীরের সঙ্গে জেলি এমনভাবে মিশে থাকে, খালি চোখে বিষয়টি ধরা কঠিন। জেলি মিশ্রিত চিংড়ির মাথার কাছে ভাঙলে এর উপরিভাগে নরম আলগা আবরণ দেখা যায়। তবে খোলস ছাড়িয়ে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে না দেখলে তা বোঝা যায় না। সহজ না হলেও এটাই ল্যাব পরীক্ষা ছাড়া বুঝতে পারার একমাত্র উপায় বলে জানায় মৎস্য বিভাগ। তারা বলছে, জেলি মিশ্রিত চিংড়ি রান্না করলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না।
স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলি বা যেসব পদার্থ চিংড়িতে প্রয়োগ করা হয়, তা মানুষের পাকস্থলীতে গিয়ে জমে থাকে। এটি খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে। ফলে শরীরে নানা জটিল রোগ হতে পারে।
কমেছে রপ্তানি
জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় চিংড়ি উৎপাদন হয় ৩৮ হাজার ৭৩ টন। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৯০৪ টন। মৎস্য বিভাগ বলছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য কমে গেছে রপ্তানি।