ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সদরপুরে সন্তান দত্তক দেওয়ার নামে নারীর প্রতারণার ফাঁদ

সদরপুরে সন্তান দত্তক দেওয়ার নামে নারীর প্রতারণার ফাঁদ

অভিযুক্ত বর্ণা আক্তার। ছবি-সমকাল

ফরিদপুর অফিস ও সদরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ২১:১০ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ২১:১১

ফরিদপুরের সদরপুরে সন্তান দত্তক দেওয়ার নামে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এক নারী। বর্ণা আক্তার (৩৫) নামে ওই নারী মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করছে বলে স্থানীয়রা জানান। এই কাজে তাকে সহায়তা করছে একটি প্রতারক চক্র।

সদরপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ণা আক্তার ভিক্ষা করে চলে। তার বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত সে। এসব অপকর্মে তাকে সহায়তা করে এলাকার একটি চক্র। 

বর্ণা আক্তার গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গোড়াকোলা গ্রামের একটি পরিবারে পালক সন্তান হিসেবে বড় হয়। পরে ফরিদপুরের নগরকান্দার চরযশোহরদী গ্রামের নুরুল ইসলাম মোল্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নানা অভিযোগে ওই এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে পরে সদরপুরের সতেররশি গ্রামে আশ্রয় নেয় বর্ণা ও তার স্বামী। তাদের পাঁচ সন্তান। বড় ছেলে ঢাকায় কাজ করে। মেজ ছেলে শারীরিভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। বড় মেয়ে একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, অপর মেয়ের বয়স আড়াই বছর। মূলত, পঞ্চম সন্তানকে দত্তক দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদ পাতে বর্ণা আক্তার। 

সদরপুর স্টেডিয়াম মাঠে ফুচকা ও চটপটি ব্যবসা করেন স্থানীয় সিদ্দিক মোল্যা। ফুচকা বিক্রির সূত্রে বর্ণা আক্তারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ণা তার পঞ্চম সন্তানকে গর্ভে থাকা অবস্থায় দত্তক দিতে চাইলে সিদ্দিক মোল্যা ও তাঁর ছোট ভাই মোখলেস মোল্যা পার্শ্ববর্তী চরভদ্রাসন উপজেলার চরঅযোধ্যা গ্রামের নিঃসন্তান বিলকিস আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই গ্রামে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন মোখলেস। সেই সূত্রে চিনতেন বিলকিস আক্তারকে। এক পর্যায়ে বর্ণা ও বিলকিসের দেখা হয়। বর্ণা তখন তার গর্ভের সন্তান দত্তক দেওয়ার প্রস্তাব দেয় বিলকিসের কাছে। বিনিময়ে চায় সিজারের খরচ, দুই মাসের ভরণপোষণ ও নগদ টাকা। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে একটি মৌখিক চুক্তি হয়। এর পর থেকে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা বর্ণাকে দেখাশোনা করতে থাকেন বিলকিস। তাকে একটি মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা দেন। সদরপুর উপজেলার বিশ্ব জাকের মঞ্জিল জেনারেল হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে কন্যাসন্তান জন্ম দেয় বর্ণা। কথামতো নবজাতককে দত্তক দেয় বিলকিসের কাছে। সব মিলিয়ে তখন বর্ণার পেছনে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান বিলকিস। 

এরপর বিলকিসের কাছে বড় হতে থাকে ওই নবজাতক। কিন্তু মাস পেরুতেই বিলকিসের কাছে টাকা দাবি করে বর্ণা। টাকা না দিলে শিশুটিকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এভাবে বর্ণা কয়েক দফা টাকা নেয় বলে জানিয়েছেন বিলকিস। এই কাজে তাকে সহায়তা করে একটি প্রতারক চক্র।
বিলকিসের কোলে শিশুটির বয়স পাঁচ মাস হয়ে যায়। গেল ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বিলকিসের বিরুদ্ধে সন্তান চুরির অভিযোগ দেয় বর্ণা। অভিযোগপত্রে সিদ্দিক মোল্যা ও মোখলেস মোল্যার কথাও উল্লেখ করে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মোরাদ আলী তাঁর কক্ষে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনেন। পরে স্থানীয়ভাবে দু’পক্ষকে সমস্যা সমাধান করে নিতে বলেন। এক সপ্তাহে সমস্যার সমাধান না হলে সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বিষয়টি দেখতে বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

গত ৩ মার্চ সদরপুর থানা পুলিশ সিদ্দিক মোল্যাকে থানায় নিয়ে আসে। পরদিন বিলকিস আক্তারকে থানায় ডাকা হয়। উভয় পক্ষের কথা শুনে বর্ণা আক্তারকে ৭২ হাজার টাকা জরিমানা করেন ওসি (সন্তানের ভরণপোষণ ও অপারেশনের খরচ)। শিশুটিকেও তার কাছে বুঝিয়ে দেন। বর্ণা ৫২ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। স্থানীয়রা বলছেন, শিশুটিকে বেশি টাকায় অন্যত্র বিক্রির জন্য বিলকিসের কাছ থেকে নিয়ে এসেছে বর্ণা, এটি তার প্রতারণার ফাঁদ।

এ বিষয়ে বিলকিস আক্তার বলেন, ‘নিজের সন্তানের মতো ৫ মাস লালন-পালন করে শিশুটিকে বড় করলাম। নাম রাখলাম ফারজানা। মামলার ভয় দেখিয়ে শিশুটিকে তারা আমার কোল থেকে কেড়ে নিল।’ শিশুটিকে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে তাকেও তারা এভাবে জিম্মি করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বর্ণা আক্তার বলেন, ‘তখন ভুল করেছিলাম। এখন সন্তান ফেরত পেয়েছি। জরিমানার টাকা দিয়ে দেব।’ সন্তান দত্তকের নামে প্রতারণা ও অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি।

সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল আলম সমকালকে বলেন, ‘বর্ণা শিশুটিকে নিয়ে বিলকিসের সঙ্গে ছলচাতুরি করেছে। বিষয়টি মানবিক, তাই বাচ্চাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি।’ বর্ণা আক্তারের কার্যকলাপ আইনের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আরও পড়ুন

×