কুমিল্লার মেয়র তাহসীন বাহার সূচনা
বাহারি কেরামতিতে বাহার কন্যাই ‘নগরকন্যা’
সিটি নির্বাচন

সূচনা
জাহিদুর রহমান, কুমিল্লা থেকে
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৪ | ০০:৪০ | আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ | ০১:৩২
যেমনটা শঙ্কা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনটাই হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) মেয়র পদে উপনির্বাচনে মেয়েকে জেতাতে সংসদ সদস্য (এমপি) আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ‘বাহারি’ কেরামতি দেখেছে নগরবাসী। দিনভর সুকৌশলে ভোটের নাটাই নিজের হাতেই রাখেন বাহার। কেন্দ্র থেকে অন্য প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া, কেন্দ্রের সামনে কর্মী বাহিনীর জটলা, পথে পথে বাধা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি, ভীতি ছড়ানোসহ বাহারের নির্বাচনী প্রতাপের কাছে ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’ করেন ডা. তাহসীন বাহার সূচনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। শেষমেশ বাবার ‘আশীর্বাদে’ আগামী চার বছরের জন্য কুমিল্লা নগরীর চাবি সূচনারই হলো, প্রথম নারী নগরকন্যা হিসেবেও করলেন ‘সূচনা’। তবে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
দিনভর ভোট শেষে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে কুমিল্লা জিলা স্কুল মিলনায়তন থেকে ফল ঘোষণা আসে। বাস প্রতীকে ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে বিজয়ের হাসি হাসেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সূচনা। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা দু’বারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট, মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ১৭৩ ভোট। মোট ভোট পড়েছে ৩৮.৮২ শতাংশ।
বিজয়ী হয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় তাহসীন বাহার সূচনা বলেন, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে জনগণের ভালোবাসার প্রতিদান দেব।
গোলাগুলি, এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ
১০৫ কেন্দ্রেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা চলে ভোট গ্রহণ। উত্তেজনা দেখা দেয় ভোট শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং আশপাশের এলাকায় এমপিকন্যা সূচনার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। বেশির ভাগ কেন্দ্রে অন্য প্রার্থীর এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন কেন্দ্রের গলির মুখে ও সড়কের মোড়ে মোড়ে পাহারা বসান সূচনার কর্মী-সমর্থকরা। তাদের মধ্যে বহিরাগত ও কিশোরের সংখ্যা বেশি। বাস প্রতীকের সুনির্দিষ্ট ভোটার ছাড়া অন্য কাউকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অন্য প্রার্থীরা। নগরের অন্তত ২৫ কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ দেখে ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভিযোগ থেকে এমন তথ্য মিলেছে।
শনিবার সকাল ১০টার দিকে নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নেউরা এলাকায় মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দু’পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে দু’জন গুলিবিদ্ধ হন, আহত হন আরও দু’জন। আহতরা ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সারের সমর্থক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কুমিল্লা নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশেই ঘোড়া প্রতীকের সমর্থকদের সঙ্গে বাস প্রতীকের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হন পাঁচজন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ নুরুজ্জামান সুজন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জহিরুল ইসলাম ও জাভেদ আহমদকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ‘সূচনার সমর্থকরা ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দেননি। বিভিন্ন স্থানে তারা আমার সমর্থকদের ওপর হামলা করে।’
মেয়র প্রার্থী সাক্কুর ব্যক্তিগত সহকারী কবির হোসেন মজুমদার অভিযোগ করেন, ফল ঘোষণা শুরু হলে নগরীর কাপ্তানবাজারে বাদল মিয়া ও শুভপুরের ইকরাম হোসেন ইকুর বাড়িতে বাস প্রতীকের কর্মীরা হামলা-ভাঙচুর চালায়। অনেক নেতাকর্মী ভয়ে এখন বাড়িছাড়া।
ভোট গ্রহণ শেষে ফল ঘোষণার আগেই কুমিল্লা নগরীর মোড়ে এমপি বাহারের সমর্থকরা বিজয় মিছিল বের করেন। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আতশবাজির শব্দ। এ সময় শহরে তৈরি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি।
এদিকে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়ারও ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, ভোট গ্রহণ শুরুর পর সকালেই কুমিল্লা হাই স্কুল কেন্দ্রে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়।
কুমিল্লা হাই স্কুল কেন্দ্রে সকাল ৮টার আগেই টেবিল ঘড়ি ও ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখলে নেওয়া হয়। সকাল ৯টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে বাস প্রতীক ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। দু-একটি বুথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আরেক প্রার্থী নূর উর রহমানের হাতি প্রতীকের এজেন্টকে দেখা গেছে।
এ ছাড়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রিয়াজ উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন্স স্কুল, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আকরামউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও দৈয়ারা স্কুল, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের শাকতলা প্রাইমারি ও হাই স্কুল কেন্দ্রেও টেবিল ঘড়ি প্রতীকের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সব প্রার্থীরই এজেন্ট আছে। তবে কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, বাস প্রতীকের লোকজন এসে সকালেই অন্য এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। তবে তাদের গলায় থাকা কার্ড নিয়ে বাস প্রতীকের সমর্থকরা কেন্দ্রে বসেছেন। এখানে অন্য প্রার্থীর কার্ড ঝুললেও আসলে তারা বাস প্রতীকের সমর্থক।
এ ব্যাপারে মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘অনেক কেন্দ্রে আমার পোলিং এজেন্ট ঢুকতে পারেনি। আর জনগণ ভোট দিতে যাইব কেমনে? একজন মানুষের কাছে আমরা সবাই অসহায়।’
ভোটের বিষয়ে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ‘বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা বহিরাগত লোক এনে পাড়া-মহল্লায় ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়েছে। অনেক কেন্দ্রে এজেন্ট ভয়ে যেতে পারেননি। ভোটাররা নিরাপত্তাহীনতায় কেন্দ্রে যেতে পারেননি। প্রশাসনের সামনেই সব কিছু হয়েছে। উল্টো প্রশাসন ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে বলে অন্য প্রার্থীদের বারবার আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে বড় কারচুপি হয়েছে তার টের পেতেও দেয়নি।’ অপর নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, ‘ভোটারদের মারধর করা হয়েছে, বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নগরীর অনেক কেন্দ্রে বহিরাগত লোক দিয়ে ভোটারদের পেটানো হয়েছে।’
তবে ওই তিন প্রার্থীর অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. তাহসীন বাহার সূচনা বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। একটা দল (বিএনপি) আছে, দলটা সবসময় এ সরকারের সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে কথা বলে যায়। আমার মনে হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম কিছুই হচ্ছে। যতদূর আমি জানি, আমাদের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের কর্মী গুলি খেয়েছে। অভিযোগ আমার দিকে কেন, সেটা আমি জানি না।’
অভিযোগের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘যখন যেখানে অভিযোগ পেয়েছি, সেখানেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। ফলে বড় রকমের কোনো গোলযোগ হয়নি। ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।’
গাড়িতে দিনভর ঘুরেছেন এমপি বাহার
গতকাল দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ একটি সাদা গাড়ি নিয়ে কুমিল্লা হাই স্কুলের সামনে আসেন এমপি বাহার। তাঁর গাড়ি দেখে মুহূর্তে কেন্দ্রের সামনে জড়ো হন কয়েকশ নেতাকর্মী। গাড়িতে বসেই তিনি মেয়ে সূচনার পক্ষে নানা নির্দেশনা দেন। এর পর থেকে এমপির গাড়ির পিছু নেয় সমকাল। বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিরামহীন ছুটেছেন বাহার। নগরের অধিকাংশ কেন্দ্রের সামনে তাঁর গাড়ি থেমেছে। তবে তিনি গাড়ি থেকে নামেননি। জানালার গ্লাস খুলে ৪-৫ মিনিটের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরের এক বাসিন্দা বলেন, এমপি বাহারের ভোটের মাঠে এমন তৎপরতা মেয়ে সূচনার পক্ষে প্রভাব পড়েছে। তিনি যেখানে গেছেন, সেখানে অন্য পক্ষের ভোটাররা আতঙ্কে ছিলেন। নির্বাচনের দায়িত্বে এক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমপির ভোট দেওয়া ছাড়া কোনো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে এমপি বাহারের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। বক্তব্য নিতে তাঁর গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এড়িয়ে যান। এ পর্যায়ে জানালার গ্লাস তুলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যান। পরে তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি।
- বিষয় :
- কুমিল্লা সিটি করপোরেশন
- নির্বাচন