ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ডায়ালাইসিস সেবা পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’

চট্টগ্রামের চিত্র

ডায়ালাইসিস সেবা পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’

প্রতীকী ছবি

 শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ০৭:৩৩ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ১০:১৩

আক্রান্ত রোগীর শারীরিক অবস্থা ও কিডনির কার্যকারিতা অনুযায়ী একজন রোগীকে প্রতি মাসে অন্তত ৮ থেকে ১২ বার ডায়ালাইসিস করানোর প্রয়োজন পড়ে। সবকিছু মিলে বেসরকারিভাবে একবার ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে গুনতে হয় পাঁচ হাজার টাকার বেশি। এ হিসাবে একজন রোগীর প্রতি মাসে প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা; যা গরিব-অসহায় রোগীর পক্ষে বহন করা অসম্ভব। এমন বাস্তবতায় চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সরকারিভাবে সহজলভ্য নয় চিকিৎসাসেবা।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে একমাত্র ভরসার জায়গা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কিডনি ওয়ার্ডটি এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখানে মেশিনের তুলনায় প্রতিদিন সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা থাকে ১০ গুণের বেশি। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ থেকে এখানে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে ডায়ালাইসিস সেন্টারটির দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় কোম্পানি স্যান্ডর। তবে এই সেন্টারটি রোগী-স্বজনের কাছে ‘বিষফোড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা প্রায় সময় নানা অজুহাত দেখিয়ে হঠাৎ সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এতে রোগীদের বেশির ভাগ সময় পড়তে হয় চরম ভোগান্তি ও হয়রানিতে।

টাকার অভাবে মোট রোগীর ৩৯ শতাংশ মাঝপথেই ডায়ালাইসিস নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের পরিচালিত এক গবেষণায়। আর ডায়ালাইসিস শুরুর আগে ৩২ শতাংশ রোগীর মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা থাকলেও তা পরে ১২ শতাংশে নেমে আসার তথ্য উঠে এসেছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালিত আরেক গবেষণায়। তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, গত দেড় বছরে ১০ বারের বেশি নোটিশ টানিয়েই সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় স্যান্ডর কর্তৃপক্ষ। অথচ চুক্তি অনুযায়ী স্যান্ডর কোম্পানি এভাবে সেবা কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে না বলে বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ভরসা কেবল ১৫ মেশিন

প্রতিষ্ঠার পর থেকে চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগে মাত্র চারটি ডায়ালাইসিস মেশিন দিয়ে সেবা কার্যক্রম চলে আসছে, যা রোগীর তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এ অবস্থায় দূরদূরান্ত থেকে আসা প্রতিদিন অনেক রোগীকে সেবা না নিয়েই ফিরতে হয়। গত বছরের ৭ জানুয়ারি ডায়ালাইসিস মেশিন বৃদ্ধি, ফি কমানো, সেবা বাড়ানোসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন রোগী-স্বজনরা। ১০ জানুয়ারি সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনের সময় তাদের ওপর চড়াও হয়ে হামলা চালায় পুলিশ। এ ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সে সময় নতুন ১০টি মেশিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরে ২২ জানুয়ারি সেসব নতুন মেশিন বসানো হয়। এর সঙ্গে করোনা রোগীদের পুরোনো তিনটি মেশিন বসানো হয়। জোড়াতালি দিয়ে মেশিনের সংখ্যা ১৭টি করা হয়। তবে বর্তমানে দুটি অচল পড়ে আছে। সচল থাকা মেশিনগুলো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া সম্ভব। তবে সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা এর ১০ গুণের বেশি। 

হাটহাজারীর কাটিরহাটের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব রোগী লাইলুন নাহার বলেন, অনেক ঝক্কি-ঝামেলা ও ভোগান্তি পার করে হাসপাতালে এসে দেখি লম্বা সিরিয়াল। ডায়ালাইসিস সেন্টারে সেবা কার্যক্রম বন্ধ। এ অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে সীমাহীন কষ্ট পেতে হয়।

এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান সমকালকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যে কারণে কম সংখ্যক মেশিন দিয়ে বাড়তি রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে হাসপাতালের কিডনি ওয়ার্ডকে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এবং ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা আরও বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। বকেয়া আদায়ের নামে ও নানা অজুহাতে স্যান্ডরের হুটহাট সেবা কার্মক্রম বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে আমরাও বিব্রত। প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার জানিয়েছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্যান্ডরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় বাড়ছে সরকারের কাছ থেকে বকেয়ার হারও। চুক্তি অনুযায়ী আমাদের বকেয়ার টাকা নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। প্রয়োজনীয় অর্থ না পাওয়ায় ডায়ালাইসিসের যাবতীয় কাঁচামাল কেনা সম্ভব হয় না। এ কারণে সেবা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।

চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা বলেন, সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত না হওয়ায় ক্রনিক কিডনি ডিজিজ আরও খারাপের দিকে চলে গিয়ে কিডনি অকেজো হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যে কারণে এটি শেষ পর্যায়ের কিডনি রেনাল ডিজিজ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। সঠিক সময়ে ডায়ালাইসিস নেওয়া সম্ভব না হলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, খেটে খাওয়া মানুষ যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়, তবে তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা বহন করা সম্ভব হবে না। গরিব-অসহায় রোগীদের এই চিকিৎসা খরচ রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। 

‘সবার জন্য সুস্থ কিডনি’– এই প্রতিপাদ্যে বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে আজ চমেক হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করবে।

আরও পড়ুন

×