স্লিপার ভেঙে নাকি রেললাইন বেঁকে দুর্ঘটনা, নিশ্চিত নয় কর্তৃপক্ষ
কুমিল্লায় বিজয় এক্সপ্রেসের ৯ বগি লাইনচ্যুত, আহত ১০
ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে রোববার বিজয় এক্সপ্রেসের ৯ বগি লাইনচ্যুত হয় সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক ও নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৪ | ০০:২৮
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায় বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন ট্রেনের আট যাত্রীসহ ১০ জন। গতকাল রোববার দুপুরে উপজেলার ঢালুয়া ইউনিয়নের হাসানপুর স্টেশনসংলগ্ন তেজেরবাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সিলেট ও জামালপুরগামী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। রাত ৯টার দিকে বগিগুলো উদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষ করতে সাত-আট ঘণ্টা লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। স্লিপার ভেঙে নাকি রেললাইন বেঁকে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয় নিশ্চিত করেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্থানীয় ও রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস দুপুর দেড়টায় নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুর ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী স্টেশনের মধ্যবর্তী তেজেরবাজার এলাকায় পৌঁছলে ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়। আপ লাইনের ২০৮ নম্বর সেতুর কাঠের স্লিপার ভেঙে যাওয়ায় সজোরে ধাক্কা লেগে ট্রেনের ইঞ্জিনে থাকা লক ভেঙে যায়। এতে বগিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় আপ লাইনের ৩০০ মিটার লাইন স্লিপার থেকে খুলে অন্তত ১০০ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় আহত যাত্রীসহ আটজনকে নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। বগিগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের উভয় লাইনে ছড়িয়ে থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-সিলেট, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-জামালপুর রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। আহতরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
এদিকে বিজয় এক্সপ্রেস পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের সূত্র জানিয়েছে, হাসানপুর স্টেশনের দুই কিলোমিটার আগে ট্রেনের লোকোমাস্টার (চালক) দেখেন, একটি সেতুতে রেললাইন বেঁকে রয়েছে। এ খবর আগে থেকে জানা ছিল না। সেই সময় ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। বাঁকা দেখে চালক গতি কমান। সেখানে গিয়ে ট্রেন ইঞ্জিনের সঙ্গে বগির সংযোগ বাফার (কাপলিং) ভেঙে যায় এবং ইঞ্জিনের হোস পাইপ খুলে যায়। এতে ইঞ্জিন থেমে গেলে পেছন থেকে বগি এসে ধাক্কা দিলে ছিটকে পড়ে লাইনচ্যুত হয়। কী কারণে কাপলিং ভেঙেছে, তা জানাতে পারেনি রেল সূত্র।
সরেজমিন দেখা যায়, তেজেরবাজারের দক্ষিণ পাশে দুই লাইনজুড়ে বিজয় এক্সপ্রেসের ৯টি বগি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এর মধ্যে একটি বগি পড়ে আছে রেলপথসংলগ্ন চিওড়া গ্রামের হতদরিদ্র বৃদ্ধ চান মিয়ার ঘরের ওপর। ঘরটি তছনছ হয়ে গেছে। বগি ছিটকে পড়ে আহত হয়েছেন চান মিয়া ও তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। ঘর নির্মাণে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।
আহত ট্রেনযাত্রী কিশোরগঞ্জের মিরাজ হোসেন বলেন, সেতুর ওপর ওঠার পর বিকট শব্দ করে বগিগুলো ছিটকে পড়ে। এ সময় আমিসহ অনেকেই আহত হয়েছেন।
লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি মুরাদ উল্লাহ বাহার জানান, দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হননি। কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে শুনেছি। তাদের আমরা আসার আগেই স্থানীয়রা হাসপাতালে পাঠান।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম রেললাইন বেঁকে দুর্ঘটনা ঘটার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কয়েকটি কারণের কথা শোনা গেলেও দুর্ঘটনা কেন ঘটেছে, তা তদন্তে জানা যাবে। ঘটনা তদন্তে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনিসুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার মতো গরম এখনও পড়েনি। রেলপথের স্লিপার ভাঙা থাকার কথাও নাকচ করেছেন তিনি।
সাইফুল ইসলাম আরও জানান, চট্টগ্রাম ও আখাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে আসা দুটি রিলিফ বগি উদ্ধারে কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। তিনিও বলেছেন, তদন্তে বিস্তারিত জানা যাবে।
কুমিল্লার লাকসাম-চিনকি আস্তানা সেকশনে ব্রিটিশ আমলের রেললাইনের সমান্তরালে নির্মাণ করা ৬১ কিলোমিটার মিটারগেজ পথ ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল চালু হয়। ১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকায় নির্মিত এ রেলপথের মাধ্যমে সেকশনটি উন্নীত হয় ডাবল লাইনে। গতকাল মাত্র ৯ বছরের পুরোনো এ লাইনে দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের সূত্র জানিয়েছে, লাইনটিতে প্রায়ই বাঁক দেখা যায়। চৈত্র মাসের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় লাইনে বাঁক সৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়। পর্যাপ্ত পাথর না থাকায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় বাঁক সৃষ্টি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ তাপে ইস্পাতের তৈরি রেললাইন সম্প্রসারিত হয়। নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হলে জোড়ার স্থানগুলোতে রেললাইন বেঁকে যেতে পারে। ট্রেন চলাচলের সময় চাকার সঙ্গে রেললাইনের ঘর্ষণে আরও তাপ উৎপন্ন হয়। ফলে অতি তাপে লাইন বেঁকে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোথাও বাঁক তৈরি হয়েছে কিনা, তা দেখতে রেললাইন পরিদর্শনের কথা। যেসব এলাকায় লাইন দুর্বল, সতর্কতার সঙ্গে ট্রেন চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতি কমিয়ে কত হবে, তা লাইন ও ট্রেনের অবস্থার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন চালক। কিন্তু গতকাল উচ্চ তাপমাত্রা ছিল না। তাই অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, তা মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল নাঙ্গলকোটের হাসানপুর স্টেশনে একটি কনটেইনারবাহী মেইল ট্রেনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ছাড়া কনটেইনারবাহী মেইল ট্রেনেরও একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ১৯ এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল রেলওয়ে স্টেশনে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি।
- বিষয় :
- রেল দুর্ঘটনা