অবৈধ কয়লায় বন্দরে বিপত্তি

সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এসব পাহাড়ের গুহা ধরে ভারতে যায় কয়লা পাচারকারীরা সমকাল
পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪ | ২৩:০০
বৈধ পথে আমদানির পাশাপাশি প্রতিদিন অবৈধ পথে কয়লা নামছে সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে। এতে কঠিন সমস্যায় পড়েছেন বন্দরের বৈধ কয়লা আমদানিকারকরা। এ কারণে মরতে বসেছে কয়লার বাজার। বৈধ ব্যবসায়ীরা বিপাকে থাকায় রাজস্ব হারানোর শঙ্কা বাড়ছে।
শুল্ক বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের অসন্তোষের কারণে মাঝে বেশ কয়েক দিন বন্ধ ছিল স্থানীয় শুল্ক বন্দর দিয়ে কয়লা আমদানি। পরে তা চালু হলে বন্দরগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। তবে অবৈধ ব্যবসায়ীদের চোরাই কয়লার কারণে অতিষ্ঠ আমদানিকারকরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন বৈধভাবে প্রায় ২৪শ টন কয়লা আমদানি করা হয়, যার প্রতি টন বিক্রি হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার ৫০০ টাকায়। এদিকে অবৈধ পথে প্রতিদিন দেশে ঢুকছে কমপক্ষে ৮০০ টন কয়লা, যা টনপ্রতি ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এতে বৈধ পথে আসা কয়লার বাজার ধ্বংসের পথে। এ ছাড়া সরকার প্রতিদিন রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। কম দামে পাওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন অবৈধভাবে আসা কয়লা কেনায়। এই অসম প্রতিযোগিতায় কীভাবে টিকবেন প্রকৃত আমদানিকারকরা, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
১১ মার্চ সুনামগঞ্জের চারাগাঁও শুল্কস্টেশনে সাংবাদিকদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পেরে তাদের সঙ্গে দেখা করেন কয়েকজন কয়লা আমদানিকারক। জানা যায়, তাহিরপুর সীমান্তের বুরুঙ্গাছড়া, লাকমা, লালঘাট, চারাগাঁও, জঙ্গলবাড়ি ও কলাগাঁও দিয়ে প্রতি রাতেই নামছে শত শত টন কয়লা। রাত ২টার পর শ’খানেক ট্রলি চোরাই কয়লা (স্থানীয় নাম বুঙ্গার কয়লা) নামানোর কাজ করে। এ সময় তড়িঘড়ি ভারতের মেঘালয়ের বড়ছড়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে শত শত বস্তা কয়লা নামিয়ে এপারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কারও ডাম্পে ঢুকিয়ে দিলেই সেটা বৈধ হয়ে যায়।
এসব তথ্য দেওয়ার সময় এক কয়লা ব্যবসায়ী বলেন, ‘নিজের পরিচয় দিতে পারতাম নায়। দিলে ঠিকতাম পারতামনায় ভাই। তারা বিজিবি, পুলিশ, সাংবাদিক হকলের (সকলের) কথা কইয়া টেকা (টাকা) তুলে। এরা বড় দলেরও নেতা। তারার ডিপোতে নিয়াও কয়লা রাখে।’
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য তাহিরপুর কয়লা আমদানি গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়েরকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘ওই ব্যবসায়ী সত্য কথা বলেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে সব চোর এক হয়ে রুখে দাঁড়ায়; সাংবাদিকরাও চাঁদা নেয়। কার কাছে বলব? বিপদে পড়ে গেছি আমরা সাধারণ কয়লা ব্যবসায়ী।’
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান জানান, সীমান্ত পথে অবৈধভাবে কয়লা নামার বিষয়টি রোববার কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের বার্ষিক সভায় সংসদ সদস্য রঞ্জিত সরকারকে জানানো হয়েছে। প্রশাসন এসব বন্ধ করতে না পারলে এখানকার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
স্থানীয় একাধিক আমদানিকারক বুঙ্গার কয়লা কেনা এবং পুলিশ, বিজিবি, সাংবাদিক ম্যানেজের দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি, বর্তমানে একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাবেদ আহমদসহ এমরুল ইসলাম, আইনুল ইসলাম ও রউফ মিয়ার মতো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার নাম জানান। তবে অভিযুক্তরা বলছেন, এসবের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।
জাবেদ আহমদ জানান, সীমান্ত দিয়ে টুকটাক কয়লা ওপার থেকে আসে। তবে সেগুলো বিজিবি ও পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে। তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অনৈতিক কাজের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নেই। এদিকে চারাগাঁওয়ের এমরুল হাসান জানান, তিনি এসব কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে উল্টো চোর হয়েছেন। তবে রউফ মিয়া জানান, গরিব মানুষ টুকটাক কয়লা এনে বিক্রি করে সংসার চালায়। তিনি আগে তোলার কাজ করতেন। তিন মাস ধরে বন্ধ করে দিয়েছেন।
চারাগাঁওয়ের একজন বড় আমদানিকারক জানান, বৈধ পথে প্রতিদিন ২০০ ট্রাক কয়লা আনেন দেশে। তাতে প্রায় ২৪শ টন কয়লা এপারে আসে। অন্যদিকে অবৈধ পথে ৭০০ থেকে ৮০০ টন কয়লা আসে প্রতি রাতে। গত দু’দিনে জঙ্গলবাড়ি দিয়েই ঢুকেছে কমপক্ষে ১ হাজার টন অবৈধ কয়লা।
বড়ছড়া কাস্টমস অফিসের সুপারিনটেন্ড আবুল হাসেম জানান, বর্ডারের লোকগুলো ভয়াবহ। এরা চোরাচালানে যুক্ত জেনেও কিছু করা যায় না। তবে বিজিবি মাঝে মাঝে এদের আটক করে। এরা বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাই কয়লা নামায়। এ সীমান্তের তিন শুল্ক স্টেশন দিয়ে দিনে ২৪শ টন কয়লা নামতে পারে। এক টন কয়লার রাজস্ব ৩ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসাবে কয়লা ঠিকঠাকভাবে আমদানি হলে দিনে রাজস্ব পাওয়া যায় ৭৬ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো। বিপরীতে চোরাই পথে ৮০০ টন কয়লা নামলে সে হিসাবে প্রতিদিন ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
- বিষয় :
- কয়লা লোপাট
- রাজস্ব